সহিদুল আলম স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড ||
অধ্যায় ১ – বনানী ১২ নম্বর রোডের বারান্দা
আমাদের বাসাবনানী ১২ নম্বর রোডে। ছোট্ট বারান্দা আমার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান। বিকেলের রোদ কাচের জানালা ভেদ করে এসে পড়ত, আর আমি বসে থাকতাম হারমোনিয়াম হাতে, সুরের সঙ্গে বাতাসে মিলিত হয়ে যেন আমার ছোট্ট মন খুলে যেত। কখনও হারমোনিয়াম, গিটার বা বাঁশি, কখনও কাগজে আঁকা সুরের খসড়া সবই ছিল আমার নিজের জগত তৈরি করার উপায়।
শৈশবকাল থেকেই আমি অটোগ্রাফ সংগ্রহের প্রতি ঝুঁকেছিলাম। নোটবুকটি কেবল কাগজ নয়; এটি ছিল ইতিহাসের ছোট্ট পৃষ্ঠা, যেখানে মানুষ, সময়, এবং মানুষের স্পর্শের ছাপ মিলিত হয়ে থাকত।
আমার বড় ভাই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবার বলতেন,
“অটোগ্রাফ শুধু স্বাক্ষর নয়। তুমি মানুষের ইতিহাস ধরে রাখছ। একদিন বুঝবে, এর মানে কতটা গভীর।”
আমি তখন পুরোপুরি বুঝতাম না। তবে অনুভব করতাম একটি অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বারান্দার কোণে বসে হারমোনিয়াম বাজানো আর নোটবুক খোলা এই দুই কাজের মাঝে আমি শান্তি খুঁজতাম। সুর বাজানো মানে কেবল গান নয়; সেটা ছিল সময়কে ধরে রাখার এক উপায়, ঠিক যেমন অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা।
অধ্যায় ২ – হারমোনিয়ামের সুরে স্বপ্নের পাখি
প্রায় প্রতিদিন দুপুরে আমি বারান্দায় বসে হারমোনিয়ামে সুর তুলতাম। ছোট্ট আঙুলগুলো কীভাবে কী চাপলে সুর বের হয়, তা ধীরে ধীরে অনুধাবন করতাম। সেই সুরের সঙ্গে আমার চিন্তা মিলত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাক্ষর, সেই স্বপ্নের অটোগ্রাফ, এবং ভবিষ্যতের ছোট ছোট অভিযান।
নোটবুকটি পাশে থাকত। প্রতিটি সুরের সঙ্গে আমি মনেই ভাবতাম যদি someday বেগম খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরও পাই, তাহলে আমার সংগ্রহ সম্পূর্ণ হবে।
হারমোনিয়ামের প্রতিটি টান আমাকে সাহস দিত। ছোট্ট মনটি বড় স্বপ্ন দেখত। আমার ছোট্ট আঙুলের ছোঁয়ায় সুরের সঙ্গে স্বপ্নও নেচে ওঠত।
অধ্যায় ৩ – বঙ্গভবনের শিশু-কিশোর মেলা
সেই দিনটি ছিল জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। বঙ্গভবনের শিশু-কিশোর মেলা। রঙিন পতাকা, স্টল, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শিশুদের হাসি সবকিছু যেন আমাকে অন্য জগতে টেনে নিল।
হঠাৎ চোখে পড়ল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি শিশুদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে সেই সিগনেচার সানগ্লাস । চারপাশে উজ্জ্বলতা, অথচ কোনো হট্টগোল নেই।
আমি ধীর পায়ে এগোলাম। বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে গেছে। তারপরও বললাম
“স্যার… আমি কি আপনার অটোগ্রাফ পেতে পারি?”
তিনি থমকে তাকালেন, হাসলেন।
“অবশ্যই। তোমরা দেশকে ভালোবাসো এটাই আমাদের শক্তি।”
কলম তুলে তিনি আমার নোটবুকে স্বাক্ষর করলেন। সেই মুহূর্তে মনে হলো সময় থমকে গেছে। বাতাসও নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ভাবলাম এই পাতার নিচে যদি বেগম খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরও থাকে, তাহলে আমার সংগ্রহ পূর্ণ হবে।
অধ্যায় ৪ – শহীদ মইনুল রোডের অভিযান
এক দুপুরে, বুকের ভেতর সেই স্বপ্ন নিয়ে আমি শহীদ মইনুল রোডে পৌঁছালাম। বাড়িটি নীরব, গেট লোহার তৈরি। দুই সেনা গার্ড সামনেই দাঁড়িয়ে।
আমি বললাম,
“আমি বেগম খালেদা জিয়ার অটোগ্রাফ নিতে এসেছি।”
গার্ডরা কঠোর দৃষ্টিতে আমাকে দেখলো।
“এভাবে ঢোকা যাবে না,” বললেন।
মুহূর্তে মনে হলো সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
কিন্তু তখন মনে পড়ল জিয়াউর রহমানের অটোগ্রাফ। আমি নোটবুক খুলে দেখালাম এবং বললাম
“এটা ম্যাডামকে দেখান… দেখলেই আমাকে ডাকবেন।”
গার্ডটি অবাক হয়ে ভিতরে চলে গেল। আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বুকের ধকধক শুনতাম।
কিছুক্ষণ পর আরেকজন কর্মকর্তা এসে বললেন,
“চলো, তোমাকে ভেতরে ডাকা হয়েছে।”
গেট খোলার শব্দে মনে হলো স্বপ্নের দরজা খুলেছে।
অধ্যায় ৫ – বসার ঘরে বেগম খালেদা জিয়া
বাড়ির ভিতরে শান্তি। ধীরে ধীরে বসার ঘরে ঢুকলাম। বেগম খালেদা জিয়া বসে আছেন সাদামাটা, কিন্তু চোখে গভীর নীরবতা।
আমি নোটবুক এগিয়ে দিলাম। তিনি প্রথমে দেখলেন স্বামীর স্বাক্ষর। এক মুহূর্তে যেন চোখে গভীর আবেগ নেমে এলো।
“তুমি মুকুল ফৌজ করো? খুব ভালো। দেশকে ভালোবাসো। একদিন তোমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে,” বললেন।
তারপর কলম ধরে জিয়াউর রহমানের স্বাক্ষরের নিচে নিজের স্বাক্ষর করলেন।
সেই মুহূর্তে মনে হলো আমি ইতিহাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি।
অধ্যায় ৬ – বাড়ি ফেরার পথ এবং আত্মতৃপ্তি
বাড়ি ফেরার পথে বনানীর রাস্তাগুলো যেন আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। হাওয়া বইছিল, রোদ গায়ে পড়ছিল।
নোটবুকটি তখন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
বারান্দায় বসে হারমোনিয়াম বাজানো আর নোটবুক খোলা দুটি কাজই আমাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিত।
আমি বুঝেছিলাম সৃষ্টি ও ইতিহাস একসাথে অনুভব করা যায়।
অধ্যায় ৭ – স্কুল জীবন ও বন্ধুদের সঙ্গে মেলবন্ধন
স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দিন কাটত। কেউ জানত না, আমার ছোট্ট নোটবুকে কত অমূল্য স্বাক্ষর জমে আছে। গান-বাজনার সঙ্গে আমি অনেক কিশোরের মন জয় করতাম। হারমোনিয়াম বাজানোর সময় সবাই আমার পাশে দাঁড়াত। সুর এবং স্বাক্ষরের প্রতি আগ্রহ আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত।
অধ্যায় ৮ – সংগ্রহের আনন্দ
নোটবুক খুলে বসে আমি নিজেকে দেখলাম ছোট্ট কিশোর, কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর আমার জন্য এক অবিস্মরণীয় উপহার।
প্রতিটি অটোগ্রাফ কেবল কালি নয়; প্রতিটি একটি গল্প, একটি মানুষ, একটি সময়।
অধ্যায় ৯ – হারানো স্মৃতি
কিন্তু জীবন শুধু পাওয়ার গল্প নয়। সেই নোটবুক সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে।
আজ সেই দুটি অটোগ্রাফ আর নেই।
যখন হারমোনিয়াম হাতে নিই, মনে হয় হয়তো সেই দিনের হাসি, স্বপ্ন, উচ্ছ্বাসও হারিয়ে গেছে।
অধ্যায় ১০ – আজকের শূন্যতা
গান-বাজনা, অটোগ্রাফ, স্বপ্ন অনেক কিছুই নেই।
কিন্তু স্মৃতি রয়ে গেছে।
স্বাক্ষর আর নেই, কালি নেই কিন্তু গল্পের কালি কখনও মুছে যায় না।
আমি এখনও সেই ছোট্ট কিশোরের ভেতর বাস করি,
যিনি প্রথমবার ইতিহাসকে হাতে ধরে দেখেছিল, প্রথমবার স্বপ্নকে ছুঁয়েছিল।
অধ্যায় ১১ – হারমোনিয়ামের সুরে ফিরে দেখা
হারমোনিয়াম বাজালে মনে পড়ে ছোট্ট বারান্দার বিকেল, সেই দিনগুলো যখন স্বপ্ন ও ইতিহাস একসাথে মিলিত হতো।
সুর আর স্মৃতি আমাকে মনে করিয়ে দেয় সব হারালেও কিছুই সত্যিকারের হারায় না।
অধ্যায় ১২ – নোটবুকের স্মৃতি এবং পরিবারের কথাগুলো
বড় ভাই বলতেন “মুকুল, ইতিহাস কখনো ছোট নয়। তোমার হাতেই যদি ছোট স্মৃতি থাকে, তা বড় হয়ে ওঠে।”
বাড়ির প্রাচীর, আমার মা-বাবার কথা সবকিছু মনে পড়ে।
হারানো নোটবুকের কষ্ট আর এই কথাগুলো আমাকে শক্তি দেয়।
অধ্যায় ১৩ – বন্ধুদের সঙ্গে স্মৃতিচারণ
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত “কেন এত আগ্রহ অটোগ্রাফে?”
আমি বলতাম “কারণ এগুলো শুধু স্বাক্ষর নয়, এগুলো আমার শিশুকাল, স্বপ্ন, সাহস।”
হারমোনিয়ামের সুর আর নোটবুকের স্মৃতি সবসময় আমাকে তাদের সঙ্গে পুনরায় মিলিয়ে দেয়।
অধ্যায় ১৪ – হারানো আর আবিষ্কারের মাঝের সেতু
আমার কাছে আজ অটোগ্রাফ নেই, নোটবুক নেই।
কিন্তু আমার মধ্যে সেই সাহস, সেই স্বপ্ন, সেই সংগৃহীত স্মৃতি আছে।
হারানো স্মৃতি আমাকে আরো শক্তিশালী করেছে, আমাকে আরও গভীরভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
অধ্যায় ১৫ – স্মৃতি, সুর এবং পুনর্জন্ম
স্মৃতি এবং সুর দুটি মিলিত হয়ে আমাকে জানায়, কিছু হারালেও গল্প, ইতিহাস এবং স্বপ্ন কখনো মরে না।
আমি এখনও গান-বাজনা করি, হারমোনিয়ামে সুর তুলি, এবং সেই ছোট্ট কিশোরকে মনে করি যিনি সাহসী হয়ে ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছিল।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন