ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : শীত আল্লাহর নিয়ামতে ভরপুর এক ঋতু

gbn

শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক ||

আমরা যখন শীতের মাঝামাঝি সময়ে প্রবেশ করছি, তখন চারপাশের পরিবর্তন আমাদের চোখে না পড়ে পারেই না। অল্প কিছুদিন আগেও আমরা হালকা পোশাকে, হয়তো শুধু একটি হুডি পরে, শরতের শেষের নরম রোদ গায়ে মেখে মসজিদে আসতাম । আর আজ আমরা কোট, মাফলার পরে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছি।

এই পরিবর্তন হঠাৎ করে হয়নি। এটা কাকতালীয় নয়।এটা কোনো দুর্ঘটনাও নয়। এগুলো সবই আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও নিখুঁত সিদ্ধান্তের নিদর্শন।

একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই গরমকালকে শীতকালে পরিণত করেন। লম্বা দিনকে লম্বা রাতে বদলে দেন। আরামকে কষ্টে রূপ দেন। তিনি তা করেন কোনো পরিশ্রম ছাড়াই, কোনো দেরি ছাড়াই, কোনো ভুল ছাড়াই । আর ঠিক যেমন ঋতু (সিজন) বদলায়, তেমনি আমাদের জীবন, আমাদের হৃদয় ও আমাদের পরিস্থিতিও তাঁর আদেশে পরিবর্তিত হয় ।

শীত নিজেই একটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার বার্তা। এটি শুধু দৃঢ় ঈমানদারদের জন্যই নয়, দুর্বল ঈমানের মানুষ, দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি অস্বীকারকারীর জন্যও। এই নিদর্শনগুলো মানুষকে থামতে বাধ্য করে এবং প্রশ্ন করতে শেখায়-সবকিছু কে নিয়ন্ত্রণ করছে? আকাশ, বাতাস, তাপমাত্রা কে বদলায়? আমরা যদি না করতে পারি, তবে কে? এসব মনে করিয়ে দেয়—এই দুনিয়া নিজে নিজে চলছে না। প্রকৃতি নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি। জীবন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া চলছে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শন। (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০)। তিনি আরও বলেন আল্লাহ রাত ও দিনকে পরিবর্তন করেন। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে শিক্ষা তাদের জন্য, যারা উপলব্ধি করে।” (সূরা নূর, ২৪:৪৪)। কিন্তু সবাই এই শিক্ষা গ্রহণ করে না। শুধু তারাই করে—যারা থামে, যারা চিন্তা করে, যারা আত্মিক উদাসীনতায় জীবন কাটাতে চায় না।

শীত ও আখিরাতের বাস্তবতা: অনেকের কাছে শীত মানেই কষ্ট। খুবই ছোট্ট দিন, অন্ধকার সকাল, তীব্র ঠান্ডা, গরম বিছানা ছেড়ে উঠার সংগ্রাম । কারও কারও মন-মেজাজ, কাজের আগ্রহ ও নিয়মকানুনেও শীত প্রভাব ফেলে। কিন্তু মুমিন শুধু চোখ দিয়ে দেখে না। মুমিন হৃদয় দিয়ে দেখে। সঠিকভাবে বুঝলে শীত শুধু কষ্টের ঋতু নয়। বরং এটি লুকানো নিয়ামতে ভরা একটি সময়। স্মরণ, শিক্ষা এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগে পূর্ণ।

ইমাম হাসান আল বসরী (রাহ:) বলেছেন, শীত হলো মুমিনের জন্য সবচেয়ে উত্তম ঋতু। কারণ শীত হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে। শীত আমাদের জাহান্নামের বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, গ্রীষ্মের তীব্র গরম ও শীতের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা দুটোই জাহান্নামের প্রভাব থেকে । যে ঠান্ডায় আমরা কাঁপি, যে বাতাস শরীর ভেদ করে যায়—সবই স্মরণ করিয়ে দেয়।

এই দুনিয়ার ঠাণ্ডা, যা আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করেছেন, তা যদি কষ্টকর মনে হয়, তবে জাহান্নামের সেই ভয়ংকর ঠান্ডা কেমন হবে, যেখানে কোনো সহজতা নেই?

উলামারা ‘যামহারীর’ নামের এক ভয়াবহ ঠাণ্ডা স্থানের কথা বলেছেন, যা আগুন থেকেও বেশি ভীতিকর। সেখানে কোনো স্বস্তি নেই। শীত আমাদেরকে তাওবার দিকে ফিরে আসতে ডাকে । এটি মনে করিয়ে দেয়- এই দুনিয়া অস্থায়ী, আর হিসাব অবশ্যই হবে।

শীত ইবাদতের এক সুবর্ণ সুযোগ। শীত শুধু সতর্কই করে না, দরজাও খুলে দেয়। নেককার পূর্বসূরিরা শীতকে স্বাগত জানাতেন, কারণ এই সময়ে কিছু ইবাদত আল্লাহ সহজ করে দেন। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা:) বলতেন, শীতকে স্বাগত জানাও। এর রাতগুলো নামাজের জন্য দীর্ঘ, আর দিনগুলো রোজার জন্য ছোট। দীর্ঘ রাত আমাদের তাহাজ্জুদের দিকে ডাকে, যখন পৃথিবী ঘুমায়, আর বান্দা একা দাঁড়ায় তার রবের সামনে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ। তাহাজ্জুদ শুধু রমজানের জন্য নয়। এটি ভিড় বা সুন্দর কণ্ঠের উপর নির্ভর করে না। এটি বান্দা ও আল্লাহর মাঝে একান্ত সাক্ষাৎ।

হোক মাত্র দুই রাকাত। হোক দশ মিনিট। হোক একটি আন্তরিক দোয়া। প্রতিটি রাতে আল্লাহ ডাক দেন—কে ক্ষমা চাইবে, কে দোয়া করবে, কে তাঁর দিকে ফিরে আসবে? ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেছেন, রাতের নামাজের সময় করা দোয়া এমন তীরের মতো, যা লক্ষ্য নষ্ট হয় না। শীত এক উপহার । একে অবহেলা করে ঘুমিয়ে থেকো না। শীতের শীতল গনীমত রোজা। দিন ছোট। ঠান্ডা আবহাওয়া। পুরস্কার একই। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোজা রাখে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে সরিয়ে দেন।

আবু হুরাইরা (রা:) বলতেন, আমি কি তোমাদের শীতল গনীমতের কথা বলব? তা হচ্ছে, শীতকালে রোজা। ক্লান্তি ছাড়াই সওয়াব। যুদ্ধ ছাড়াই বিজয়। একটি খোলা ধনভাণ্ডার। কৃতজ্ঞতা যা কাজে পরিণত হয়। শীত আমাদের কৃতজ্ঞতাও শেখায়।

মুসলিম বিশ্বের বহু মানুষ শীত কাটাচ্ছে আশ্রয়, উষ্ণতা ও নিরাপত্তা ছাড়া । পরিবারগুলো ভেজা মাটিতে ঘুমাচ্ছে । শিশুরা কম্বল ছাড়াই কাঁপছে। বৃদ্ধরা গরমের ব্যবস্থা ছাড়াই দিন কাটাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুধু মুখের কথা নয়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় কর্মের মাধ্যমে।

গরম কাপড় দান করুন। কম্বল দিন। নিকটবর্তী ও দূরের অসহায়দের সাহায্য করুন। প্রতিবেশীর খোঁজ নিন। বৃদ্ধদের খোঁজ নিন । চুপচাপ কষ্টে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়ান। এটিও ইবাদত। এটিও আল্লাহর শুকরিয়া। শেষ কথা হচ্ছে, শীত শুধু একটি ঋতু নয়, শীত একটি বার্তা। আল্লাহর ক্ষমতাকে স্মরণ করা। আখিরাতের সতর্কবার্তা। ইবাদতের সুযোগ । কৃতজ্ঞতার পরীক্ষা। যে শীতকে বোঝে, সে তার রবকে একটু বেশি বোঝে, আর নিজেকেও।

হে আল্লাহ, আমাদের হৃদয়কে জাগ্রত করুন, আমাদের ইবাদত কবুল করুন, আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং এই শীতকে আমাদের জন্য তাঁর আরও নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম বানান। আমিন।

শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম ও খতীব, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন