শায়খ রাশিদ খান ||
একবার নবী মুহাম্মদ (সা:) তাঁর প্রিয় সঙ্গী মুআয ইবন জাবাল (রা.)-এর হাত ধরে বললেন, “হে মুআয, আমি তোমাকে ভালবাসি' । তারপর তাঁকে একটি উপহার দিলেন। বললেন, প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে একটি দোয়া পড়তে ভুলে যেয়োনা। দোয়াটি হচ্ছে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আ'লা জিকরিকা ও শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিক । হে আল্লাহ, আমাকে আপনার স্মরণ, কৃতজ্ঞতা এবং সুন্দর ইবাদতে সাহায্য করুন।”
এই দো’আ নামাজের পর বাড়তি কিছু নয়—এটা নামাজকে পরিপুর্ণ করে। অর্থাৎ নামাজ শেষ করার পরও আমাদের আল্লাহর সাহায্য চাওয়া দরকার—যেন আমরা স্মরণ করতে পারি, কৃতজ্ঞ হতে পারি, এবং ইবাদতকে সুন্দর করতে পারি।
আমাদের ইবাদতে ফাটল থাকে—কখনো মনোযোগের অভাব, কখনো তাড়াহুড়া, কখনো খারাপ অভ্যাসের কারণে । আর মেরামত শুরু হয় ত্রুটি স্বীকার করা এবং আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার মাধ্যমে।
নামাজের পরিপূর্ণতা শুরু হয় না মসজিদে । শুরু হয় অন্তর থেকে। অজুর আগেই, বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই, সুন্দর কাপড় পরার আগেই—আমরা দেখি আমাদের নিয়ত ঠিক আছে কি না। আমরা কি আল্লাহর জন্যই যাচ্ছি? আল্লাহর সাথে সংযোগের জন্য প্রস্তুত?
নবী (সা:) শিখিয়েছেন যে অজু ঠিকভাবে করতে হবে । ইসবাগুল ওযু—অর্থাৎ প্রতিটি অঙ্গ ভালোভাবে ধোয়া, শুকনো না রাখা, তাড়াহুড়া না করা। বিশেষ করে শীতকালে, যখন ঠান্ডার কারণে ঢিলেঢালা হয়ে যাওয়া খুব সহজ । কিন্তু আল্লাহর জন্য সেই কষ্টকে গ্রহণ করা নিজের জন্য বরকত ও সওয়াব নিয়ে আসে।
শরীয়ত কঠোরতা নয়—সহজতা চায় । তাই মোজার ওপর মাসাহ করা আলস্য নয়; এটা সুন্নাহ—যদি শর্ত পূরণ হয়। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) বলেছেন, “আমি মোজার ওপর মাসাহ করলে কোনো দোষ বোধ করি না।”
তবে নিশ্চিত হতে হবে- মোজা পুরু হতে হবে, টাখনু ঢেকে রাখতে হবে, ছেঁড়া হওয়া যাবে না। আর এখানেও নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে । সহজ পথ আল্লাহই দিয়েছেন। কিন্তু সহজটা নিতে হবে আল্লাহর নির্দেশে, নিজের সুবিধার জন্য নয়।
মসজিদে আসার প্রস্তুতি: আল্লাহ বলেছেন, “প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে যাওয়ার সময় তোমরা তোমাদের সাজসজ্জা গ্রহণ করো। অর্থাৎ বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং আন্তরিক ভক্তি—দুটোই দরকার। পরিপাটি হয়ে আসা, সুগন্ধি লাগিয়ে আসা । খাবারের গন্ধ, ধুমপানের গন্ধ, নোংরা কাপড় বা ঘুম থেকে ওঠা অবস্থায় যেন না আসি। এটা মানুষকে সম্মান করা, ফেরেশতাদের সম্মান করা, আর সবচেয়ে বেশি—আল্লাহর ঘরকে সম্মান করা। মসজিদকে আড্ডাখানা বানানো যাবে না। কফিশপে যে আলাপ ছিল, সেটা মসজিদে আর চলবে না। হ্যাঁ, অন্যদের সাথে কিছুটা কথা বলা যায়—কিন্তু সময় বের করে কুরআন পড়া, দো’আ করা বা চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাসও করতে হবে।
নামাজ নিজেই: শুধু নড়াচড়া নয়
নবী (সা:) নামাজ শুরুর আগে কাতার সোজা করতেন, কাঁধ মিলাতেন, ফাঁকা স্থান বন্ধ করতেন । কারণ শয়তান ফাঁকা দিয়ে ঢোকে পড়ে। কাতার সোজা করা শুধু নিয়ম নয়—এটা একতা। নবী (সা:) বলেছে, দুইজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একই নামাজ পড়লেও একজনের নামাজ আকাশে ওঠে, আরেকজনের নামাজ মুখে ছুঁড়ে ফেলা হয়। কারণ একজন প্রস্তুত হয়ে এসেছে, আরেকজন এসেছে শুধু অভ্যাসবশত। তাকবির শুধু মনে বললেই হয় না। মুখ না নড়লে, জিহ্বা না চললে, উচ্চারণ না হলে, তা পাঠ হয় না। আর পাঠ না হলে তা নামাজও নয়। এ ব্যাপারে আলেমরা একমত।
অনেকেই এই ভুল করেন । দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু ঠোঁট নড়ে না । এটা ভেবে যে, আমি তো খুশু করছি। নাহ, এটা শুধু খুশু নয়, এটা শুধু নীরবতা। আর নীরবতা পাঠ নয়।
নামাজে তাকবিরে তাহরিমা থেকে শুরু করে সালাম ফেরানো পর্যন্ত—শরীর ও জিহ্বা দুটোকেই সাক্ষী করতে হয়। আর নামাজ শেষে আমরা বলি 'আস্তাগফিরুল্লাহ'। কারণ আমরা পাপ করেছি বলে নয়, বরং আরও ভালো করতে পারতাম বলে।
তারপর ফিরে আসি মুআয (রা.)-এর সেই দো’আয়: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ'লা জিকরিকা ও শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিক । হে আল্লাহ, আমাকে আপনার স্মরণ, কৃতজ্ঞতা ও সুন্দর ইবাদতে সাহায্য করুন। কারণ ইবাদতেও আমরা আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী।
সুন্নাহগুলোতে অবহেলা করবেন না। যেমন- মসজিদে ডান পা দিয়ে প্রবেশ, দো’আ পড়া, এগুলো আমাদের মনকে প্রস্তুত করে, নিয়তকে শুদ্ধ করে এবং ইবাদতকে উন্নত করে।
শিশুদেরকে মসজিদে নিয়ে আসুন। ফজরের সময় মসজিদে তাকান—কত বাচ্চা দেখেন? হয়তো পাঁচ। হয়তো তারও কম।
কিন্তু সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাইরে বের হলে দেখবেন মুসলিম শিশুদের পদচারনায় মুখরিত রাস্তাঘাট। শত শত শিশু স্কুলে যাচ্ছে । কিন্তু মসজিদে নেই। নবী (সা:) বলেছেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দেবে। (আবু দাউদ)। এটা শুধু শিক্ষাদান নয়—এটা আল্লাহর আদেশ ।
শিশুদের মসজিদে আনা চাপ নয়। বরং তাদের জন্য আল্লাহর ঘরে জায়গা তৈরি করা । আপনি নিজের কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দেন যে, ইবাদত শুধু বয়সে বড় হওয়ার পর করার বিষয় নয়—এটা এখন থেকেই শুরু হয়। মসজিদে জায়গা না দিলে তারা অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নেবে।
মসজিদ কোনো ফটো স্টূডিও নয় । কোনো রেকর্ডিং স্টূডিও নয় । ভিডিও করা, ছবি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নবী (সা:) বলেছেন—জুমার খুতবার সময় হাত দিয়ে খেলা করলেও সাওয়াব কমে যায়। তাহলে ভিডিও করা বা পোস্ট করলে কী হবে? মসজিদকে সম্মান করুন ।
হে আল্লাহ, আমাদের ইবাদতকে খাঁটি, সুন্দর এবং মনোযোগপূর্ণ করুন । আমাদেরকে তাদের মধ্যে রাখুন—যারা তাদের ইবাদত পরিশুদ্ধ করে, সন্তানদেরকে দীন শেখায়, মসজিদকে সম্মান করে, এবং প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকে স্মরণ করে। আমিন।
শায়খ রাশিদ খান : অতিথি খতীব, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন