শায়খ রাশিদ খান ||
রাসূল (সা:) বলেছেন, ইসলাম শুরু হয়েছিল অপরিচিত এক বিষয় হিসেবে, এবং আবারও অপরিচিত হয়ে যাবে । অতএব সুসংবাদ সেই অপরিচিতদের জন্য যারা সঠিক পথে থাকে যখন অন্যরা বিচ্যুত হয়। এই ছোট্ট বাক্যটি এমন এক অনুভূতির জগতকে ধরে রেখেছে, যা আমরা প্রায়ই অনুভব করি—কিন্তু খুব কমই প্রকাশ করি।
ইসলাম কোনো সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছিল একাকী এক মানুষের মাধ্যমে, যিনি একটি গুহায় প্রথম ওহি পেয়ে ভয়ে কাঁপছিলেন; আর তাঁর স্ত্রী তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল হাতেগোনা ক'জন মানুষ দিয়ে, যারা গোপনে নামাজ পড়তেন, লুকিয়ে লুকিয়ে এক কিশোরের ঘরে মিলিত হতেন।
ভাবুন তো। আপনি যদি পৃথিবীর একমাত্র মুমিন হতেন? আট বছর বয়সে মাত্র তিনজনের মধ্যে একজন মুসলমান? সাহাবারা বলতেন, এক সময় আমি ছিলাম ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।
তারা জানতেন অপরিচিত হওয়া কাকে বলে। কোনো বাড়াবাড়ি বা আলাদা হয়ে থাকার নয়; বরং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও সামনে মাথা না নোয়ানোর দৃঢ় সিদ্ধান্ত। এই ভিন্নতার মধ্যে মর্যাদা আছে। কোনও বাড়তি শব্দ নেই, আত্মগর্ব নেই, শুধু সত্যকে চিনে নেওয়া আর সেটাকে হালকা না করা।
আজ আমরা এমন এক যুগে আছি যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নিজের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। তুমি তোমার মতো হও, যা খুশি তাই করো, কেউ কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু একই সাথে এক অদৃশ্য চাপ—সবাই একইভাবে ভাবো, একই জিনিস উদযাপন করো, আলাদা করে দেবে এমন সীমারেখা মুছে দাও।
এই টানাপোড়েনে অনেক মুসলমান, বিশেষ করে তরুণরা, দ্বিধায় পড়ে যায়। শুধু আল্লাহকে মানা—ইতিমধ্যে একধরনের ভিন্নতা। মুসলমান হওয়া—আরও একটি ধাপ। ইসলাম পালন করা—আরও দূরে নিয়ে যায়। আর অর্থনীতি, সম্পর্ক, পর্দা, পরিবার—এসব বিষয়ে ইসলামের নীতিতে অটল থাকা—তখন তো মনে হয় যেন শেষ মানুষটির মতো দাঁড়িয়ে আছি।
এমনকি মুসলিম সমাজের ভেতরেও ভিন্নতার স্তর আছে—যারা নামাজ রক্ষা করে, যারা গোপনে হলেও হারাম থেকে দূরে থাকে,যারা সন্তানকে স্পষ্টতা শেখায়, বিভ্রান্তি নয়,তারা কখনও কখনও অপরিচিতদের মাঝেও আরও অপরিচিত হয়ে যায়।
কিন্তু সঠিক কারণে ভিন্ন হওয়া কোনো দুর্বলতা নয়। এটা আপনার বেছে নেওয়া আনুগত্যের পরিচয়। ইসলাম কখনও আমাদের লুকিয়ে থাকতে বলেনি। অনেকে ভুল বোঝে—“অপরিচিত” মানে নাকি সমাজ থেকে দূরে থাকা। কিন্তু ইসলাম তা নয়। মানুষদের মাঝে থেকেও, তাদের উপকার করেও, তাদের কষ্ট ধৈর্যের সাথে বহন করেও একজন মুমিন উত্তম হতে পারে—রাসূল (সা:) এটাই শিখিয়েছেন।
অপরিচিত হওয়া মানে নিভে যাওয়া নয়। এটা মানে হৃদয়কে উচ্চতর একটি স্থানে স্থাপন করা। মানুষের সাথে বসা, কাজ করা, হাসা—সবই থাকবে; কিন্তু সিদ্ধান্ত ও মূল্যবোধে আপনি আল্লাহকেই বেছে নেবেন।
আমরা অনেক সময় ভাবি “অপরিচিত হওয়া” মানে বড় কোনো ত্যাগ। কিন্তু এটা দেখা যায় দৈনন্দিন ছোট ছোট সিদ্ধান্তে। ফজরের নামাজের জন্য জাগতে হবে বলে রাতের আড্ডা থেকে আগে উঠে আসা। বন্ধুদের মাঝে একমাত্র মানুষ যে ভ্যাপ/সিগারেট ছোঁয় না, অন্ধভাবে ট্রেন্ড অনুসরণ করে না। চারপাশের স্রোতের বিপরীতে থেকেও একজন তরুণীর পর্দা বেছে নেওয়া। সবাই বলছে, ব্যাংকের সুদ ছাড়া উপায় নেই, তবুও একজন যুবকের সুদ গ্রহণকে না বলা। বাবা-মা শিশুকে শান্তভাবে বোঝাচ্ছেন—কেন কিছু উদযাপন আমাদের নয়। এসবই বড় কোনো ঘটনা মনে হয় না, মুহূর্তে একটু অস্বস্তি লাগে। কিন্তু এগুলোই আসলে একজন মুমিনের অন্তর গড়ে তোলে—আমরা কে, আর কার মতো হতে চাই না—সেই রেখা টেনে দেয়।
রাসূল (সা:) বলেছেন, তুমি এই দুনিয়ায় থাক যেন তুমি একজন অপরিচিত বা পথচারী। এ কথা বলে শেখানো হয়েছে—দুনিয়ার প্রতিটি জায়গাকে নিজের বাড়ির মতো মনে করাই স্বাভাবিক নয়। পথিক ভদ্র, উপস্থিত, কৃতজ্ঞ—কিন্তু তার মন অন্য গন্তব্যের দিকে থাকে।
আমরা ভিন্নতা খুঁজি না—বরং বুঝি যে এই দুনিয়ায় পুরোপুরি মিশে গেলে, আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা বুঝে গেলে সেই অস্বস্তি আর তত ভারী লাগে না।
আজকের বড় দুঃখ—অনেক মুসলিম শিশু-কিশোর অপরের সব উদযাপনে না গেলে যেন অপরাধবোধে ভোগে, নিজেদের নিয়ে অস্বস্তি বোধ করে, আলাদা দেখাতে ভয় পায়, নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে লজ্জা পায়।
তাদের দরকার শান্ত, আত্মবিশ্বাসী দিকনির্দেশনা- উদ্বেগ নয়। তাদের শুনতে হবে—তুমি বঞ্চিত নও, তুমি শুধু অন্য জায়গায় অন্তর্ভুক্ত। আর সেটা গর্বের বিষয়। একবার এই কথা হৃদয়ে বসলে “অপরিচিতি” আর লজ্জা নয়—শক্তি হয়ে যায়। যা ছেড়ে দেওয়া হয় আল্লাহ তার বদলে আরও ভালো দেন।
প্রতিটি মুমিনের মনে রাখা উচিত—যে আল্লাহর জন্য কিছু ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দেন। (আহমদ)
কখনও ভালো বন্ধুত্ব, কখনও শান্ত অন্তর, কখনও পরিষ্কার দৃষ্টিশক্তি। কখনও শুধু এমন হৃদয় যা দুনিয়ায় আরও স্থির থাকে। আর প্রায়ই এই প্রতিদান খুব দ্রুতই আসে। আল্লাহর জন্য নির্বাচন কখনো শূন্যতার দিকে ঝাঁপ দেওয়া নয়—বরং আরও ভালো কিছুর দরজা খোলা।
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন—যারা ভেঙে গেলে জোড়ে, সবাই নত হলে দাঁড়িয়ে থাকে, আর দুনিয়া আমাদের অচেনা বললেও আমরা তাঁরই হয়ে থাকি। আমীন।
শায়খ রাশিদ খান : অতিথি খাতিব, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন