বুলবুল আহমেদ, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি:- নবীগঞ্জের ৪নং দীঘলবাক ইউনিয়ন অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রামের নাম জিয়াপুর। এই পুরো গ্রাম জুড়ে রয়েছে মাদকের সিন্ডিকেট। একটি পরিবারে সবাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। এই পরিবার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গ্রামের মাদক ব্যবসা। গত ২ জুলাই সেনাবাহিনী মাদক কারবারি মোঃ রায়েছ আলী (৪২)কে মাদকের চালান সহ আটক করে।
কিভাবে পরিবারের সবাই মাদকের সাথে জড়িয়েছে। গ্রামের মধ্যে আর অনেক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন এমন বক্তব্য এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এরকম একটি বক্তব্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে মাদক ব্যবসায়ীর মা খাদিজা বেগম বলছেন, তার ছেলে একা নয় তার বাড়ির সবাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র তোলপাড় হচ্ছে। মাদক কারবারি রায়েছ চুনারুঘাট সীমান্ত থেকে শুরু করে নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ বিস্তৃত এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল।
এ ব্যাপারে তার স্ত্রী রুপনা বেগমের কাছে জানা যায়, তার স্বামীর মৃত বাবার কাছে থেকে সে মাদক ব্যবসা শিক্ষা নেয়। এরপর সে ও তার ভাইয়েরা সহ পরিবারে সবাই মিলে মাদক ব্যবসা করতেছে। এসব কথা গুলো স্বীকার করেন তার সৎ মা খাদিজা বেগম। তিনি আরো বলেন, তাদের বাড়িতে প্রতিযোগিতা করে মাদক বিক্রি হয়।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) হবিগঞ্জের তালিকায় রায়েছ ও তার পরিবারের নাম সবার শীর্ষে রয়েছে। শুধু রায়েছ একা নয়, বাবার মৃত্যুর পর গোটা পরিবারই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তার বাবা ও এক ভাই মাদকসহ র্যাব, পুলিশের একাধিক বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বাবার মৃত্যুর পরে মাদক ব্যবসা একাই সামাল দিচ্ছেন রায়েছ।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, রায়েছের বাবা মৃত আরজু মিয়া ছিলেন এলাকার একজন বড় মাদক ব্যবসায়ী। তার ৩ ছেলে ৩ মেয়ে এবং তার বিয়ে দুটি। প্রথম স্ত্রীর সন্তান রায়েছ, দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান কয়েছ আলী ও ফয়েজ আলী। তিনজনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ছোট পুত্র ফয়েজ আলী ৩/৪ বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছে।
মাদক ব্যবসার জের ধরে সে নিখোঁজ হয়েছে বলে শুনা যায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিগত ২০১০ সালে আরজু মিয়ার মৃত্যুর পর পাল্টে যায় পরিবারটির চিত্র। সংসারের হাল ধরেই বড় পুত্র রায়েছ আলী, শুরু করেন মাদক ব্যবসা। ধীরে ধীরে পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়েই এক সময় গড়ে তুলেন মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য।
গত ২ জুলাই রায়েছ আলী সেনাবাহিনীর কাছে ২৯ কেজি গাঁজা ও নগদ ১ লক্ষ ৬ হাজার ১শ টাকা সহ তাকে আটক হওয়ার পরে তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করে। রায়েছ আলীর স্ত্রী ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছোট ভাই কয়েছ আলী ইমনকে দোষারুপ করেন। তাদের অভিযোগ কয়েছ আলীর কাছে থেকে মাদকের চালান না আনার জের ধরে রায়েছ আলীকে সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন কয়েছ আলী ইমন।
এ ব্যাপারে রায়েছ আলীর স্ত্রী রুপনা বেগম বলেন, আমার স্বামীর কাছে যে গাঁজা পাওয়া গেছে এটা কয়েছ আলী ইমন এনে রেখেছে। তাকে লাভ না দেওয়ার জন্য সে সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, মাদক ব্যবসার সাথে তার দেবর কয়েছ আলী ইমন, তার বাড়ি ও প্রতিবেশি অনেকই জড়িত। কয়েছ আলী ইমন চুনারুঘাট সীমান্তের জুয়েল এর কাছে থেকে মাদক নিয়ে এসে বিক্রি করে। আমার স্বামী একা নয় গ্রামের জুৎনা, আহাদ মিয়া, মঙ্গাই মিয়া, জিলু মিয়া, জিলুর আপন চাচি ২ জন ও আলেয়া বেগম মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। পুলিশ জানে কিন্তু কেন তাদেরকে ধরে না? কারণ কি?
এ ব্যাপারে রায়েছ আলীর ছোট ভাই কয়েছ আলী ইমন বলেন, আমি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত নয়। আমি সেনাবাহিনী দিয়ে রায়েছ আলীকে ধরিয়ে দেইনি। আমাকে যড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। তবে, তার ভাই রায়েছ একজন মাদক ব্যবসায়ী বলে স্বীকার করেন। তিনি এই বিষয়ে নবীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করেছেন।
এ ব্যাপারে আরজু মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, আমাদের বাড়ির সবাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। আমাদের বাড়ির ও পরিবারের সবাই প্রতিযোগিতা করে মাদক ব্যবসা করেন। শুধু আমার ছেলে (কয়েছ) একা দোষি হবে কেন? বাড়ির সবাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। এবং সতিনের ছেলে সৎ ছেলে রায়েছ মাদকের একজন ডিলার বলে তিনি স্বীকার করেন।
বিগত প্রায় দুই দশক ধরে অবৈধ মাদক ব্যবসা করে পুরো পরিবারটিই এখন সম্পদ আর লক্ষ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। মারণ নেশা ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করে তারা আলিশান বাড়ি ও একাধিক গাড়ির মালিক রয়েছে। ব্যাংকে আছে লক্ষ- কোটি টাকা। এই পরিবারটি'র মরণ নেশা ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রির টাকার লেনদেন আর ব্যাংকের হিসাব নিয়ে এখন চলছে নানান আলোচনা। প্রশাসন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক লোকজনকে মাসোহারা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে এই পরিবারের লোকজন সাবেক একজন এমপির ছত্র-ছায়ায় মাদক ব্যবসা করেছে বলেন এলাকায় ওপেন আলোচনা চলছে। ঐ এমপি কে নাকি ধর্মীয় বাবা ডেকে ছিলেন আরজু মিয়ার পুত্ররা। তাদের পরিবারে সবারই রয়েছে আলিশান ঘর-বাড়ি। গ্রামের মধ্যে আরও কয়েকজন মাদ্রক ব্যবসায়ী রয়েছে বলে অনেকেই জানান। এদের উৎপত্তি এই পরিবার থেকেই হয়েছে। ইয়াবাও আসে একই মাধ্যমে। তবে, বিক্রি হয় ভিন্ন ভিন্ন পন্থায়। চুনারুঘাটের ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে জুয়েল নামের একজন ইয়াবা ও গাঁজা তাদেরকে দিয়ে থাকে। রায়েছের পরিবারসহ পরিবারের সদস্যরা মাদক ব্যবসায়ীকে পাইকারি দরে ইয়াবা ও গাঁজা সরবরাহ করে।
এ ব্যাপারে জিয়াপুর গ্রামের বাসিন্ধা বর্তমান চেয়ারম্যান ছালিক মিয়া ও ইউপি সদস্য খছরু মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন বক্তব্য দিতে চাননি। তবে, মাদকের বিরুদ্ধে যেই হউক তাকে ধরলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আরজু মিয়ার পরিবার মাদকের সাথে জড়িত বলে শুনেছি।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর হবিগঞ্জ “খ” সার্কেলের পরিদর্শক ফণী ভূষন রায় জানান, গত ২ জুলাই মাদক কারবারি রায়েছ আলীকে তার বসত ঘর থেকে মাদকের চালান উদ্ধার করা হয়েছে। তার পরিবারের অনেকই এ ব্যবসায় জড়িত ও গ্রামের মধ্যে আরও মাদক ব্যবসায়ী আছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক বার অভিযান দিলেও তাদেরকে পাওয়া না যাওয়া এবার সেনাবাহিনী কৌশল অবলম্বন করে মাদক কারবারি রায়েছকে ধরতে ধরতে পেরেছে। তার পরিবার আমাদের কাছে তালিকা ভুক্ত মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। আমরা পরিবারটির প্রতি নজরদারি শুরু করেছি। শিগরিই এই গ্রামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান হবে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন