আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্য যে, ৮৪ বছরের একজন অদম্য যুবক দেশটাকে বিশ্বমঞ্চে টেনে নিয়ে যেতে যে সময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।|
যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, এই প্রজন্মের একজন অংশীজন হিসেবে তোমার দেশের কী নিয়ে গর্ব করতে পারো? ভাবনা ছাড়াই উত্তর দেব— ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক সেলিব্রেটিকে দেশের শাসক হিসেবে দেখেছি। যার জন্ম আমার সোনার বাংলাদেশে এবং যিনি আমাদের মত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। যিনি তরুণদের মতোস্বপ্ন দেখেন এবং তার স্বপ্নগুলো দিনশেষে দেশপ্রেমিক মানুষের কল্পনার সাথে একীভূত করা যায়।
আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্য যে, ৮৪ বছরের একজন অদম্য যুবক দেশটাকে বিশ্বমঞ্চে টেনে নিয়ে যেতে যে সময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, সেই সময়টিতে আমি বেঁচেছিলাম এবং তার কীর্তি গাঁথা চাক্ষুষ দেখেছিলাম- উত্তরসূরীদের কাছে বুকভরা গর্বের সাথে এসব গল্পচ্ছলে বলতে পারব। কী অসামান্য, অসাধারণ নায়কি দিয়ে তিনি মুগ্ধ করে চলেছেন সবাইকে! যারা শত্রু, তাদেরকেও অবলীলায় বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করছেন। কারো প্রতি কোন প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিশোধপরায়ণতা নাই। এসো বন্ধু হই, দেশ গড়ি- এমন প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে দিচ্ছেন প্রজন্মের কল্পিত স্বপ্নের কোলে।
অথচ, এই মানুষটিকে কীভাবে প্রজন্মের সাথে পরিচিত করা হয়েছিল? ছোটবেলায় মাহফিলে "সুদখোর" বলে কত গালাগাল দিতে শুনেছি! গরীবের রক্তচোষা হিসেবে কত কথা শোনাতে শুনেছি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল প্রাপ্তিই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো ড. ইউনূসের জন্য। হামলা-মামলা, হয়রানি করতে করতে প্রজন্ম ভালোবাসতে শুরু করলো তাঁকে। বিশ্ব দরবারে যে লোকটির উপস্থিতি পরম আরাধ্য সেই মানুষটিকে স্বভূমে চরম অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক অবস্থার মধ্যে দিয়ে জেল-জরিমানার মুখোমুখি করা হয়েছে। মজলুমের পক্ষে সবার সহমর্মিতা তৈরি হওয়ার নজির এই বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের অংশ।
ড. ইউনূস এসে জাতির সামনে ত্রাতা হয়ে দাঁড়ালেন। কোনো বিশেষণ ছাড়াই যাকে ডাকা যায়, তেমন একটি মানুষকে বাংলাদেশের নিজস্ব করে পাওয়ায় সংসর্গ বঞ্চিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। এই মানুষটির নেওয়ার কিছু নেই; বরং দেওয়ার আছে বহুকিছু। আমরা সব গ্রহণ করতে পারবো কি না জানি না, কারণ জাতীয়তার ইতিহাসে সভ্যতাকে খুব বেশি সমৃদ্ধ করার উপলক্ষ্য আসেনি এবং উপলব্ধিও করিনি।
হয়ত ডিসেম্বরেই কতিপয়ের আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন হবে। রাষ্ট্র নতুন রাষ্ট্রনায়ক পাবে। তবে, ড. ইউনূসকে এই দেশের মঙ্গলের জন্য রাখতেই হবে। অনুনয় বিনয় করে দেশ গঠনে তাঁকে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্বমোড়লদের সামনে বাংলাদেশের মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ড. ইউনূসকে বছর পাঁচেকের জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া। দেশের উন্নতিরও সম্মৃদ্ধির জন্য জাতি হিসেবে নির্বাচন নির্বাচন না করে সেই সময়টুকু নির্বিঘ্নে তাঁকে দেবো- ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় থাকাদের প্রতি সে ভরসা করা যায় না। অথচ পতিত সরকারের পতন না হলে ২০২৯ পূর্বে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
৫৫ বছরের বাংলাদেশ— এখানে স্বপ্ন এবং বাস্তবতার ব্যবধান ২৫ থেকে ৩০ বছরের। আমাদের যা পাওয়ার কথা ছিল তা পাইনি বরং বঞ্চনার ও ধোঁকাবাজির পাঁচ দশক প্রত্যক্ষ করেছি। দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের যেখানে পৌঁছানো উচিত ছিল, সেখানে আমরা পৌঁছাইনি। কেন লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি— সেটার কারণ বলা ভবিষ্যত বিবেচনায় বর্তমানে বারণ, তবে কমবেশি সবারই জানা। অতীতের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যকার কমতি পূরণ করে বাংলাদেশকে পঞ্চাশ বছর সামনে নিতে আরও পাঁচ বছর ড. ইউনূসকে দেশের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দেশের অধিকাংশ মানুষ কী মনে করে সেজন্য প্রয়োজনে গণভোট হোক।
তবে যদি কোনো উপায় না তবে ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নয়, বরং কোনো নির্বাচিত সরকারের বিশেষ অনুরোধে মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে রেখে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেশবাসীকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের এই রত্নের প্রতি অতীতে যে অন্যায় ও অবিচার হয়েছে, সেটার কাফ্ফারা হিসেবে ড. ইউনূসের নায়কোচিত বিচরণ বাংলাদেশের স্বার্থে অতীব জরুরি। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই বাস্তবতা অনুধাবন করে, তবে সেসব দলকে নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিক দল হিসেবে আখ্যা দেওয়ার জন্য নতুন কোনো ব্যাখ্যার দরকার পড়বে না।
ড. ইউনূস যা বলছেন, যেখানে যাচ্ছেন, যা করছেন— সেখানেই দেশের মঙ্গলের তরে সোনা ফলছে। বিশ্বনেতাদের মোহাবিষ্ট করার মন্ত্র তাঁর চেয়ে এই মুহূর্তে বেশি কেউ জানেন বলে প্রতীয়মান নয়। বাংলাদেশের কেউ বিশ্ব দরবারে ইউনূসের কাছাকাছিও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি- তেমনটি কোথাও কেউ নাই।
ড. ইউনূস বাংলাদেশকে কতদূর নিয়ে যেতে পারবেন, তা অনেকেই হয়ত আন্দাজও করতে পারছেন না। সারাবিশ্বের বাঘা-বাঘা রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানগণ এবং জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সত্ত্বাধীকারীরা তাঁকে যে ভালোবাসা, সমীহ ও সম্মান দেখাচ্ছেন, তার পেছনে যে বিশাল যোগ্যতা তিনি ধারণ করছেন, তা আমাদের ক্ষুদ্রতার কারণে আমরা পরিমাপ করতে পারছি না। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমরা যেন হীন বা ক্ষীণ কোনো স্বার্থ, লোভ কিংবা অযৌক্তিক ক্ষোভের কারণে তাঁকে হারিয়ে না ফেলি।
যোগ্য এবং দক্ষ মানুষদের আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ববোধ আকাশচুম্বী। আমাদের ভুলের কারণে কূলে পৌঁছানোর পূর্বেই তরী যেন মাঝ দরিয়ায় না ডোবে— জাতির জাতীয়তার অংশীদার হিসেবে সজাগ থাকা জরুরি। ড. ইউনূসকে দেশের স্বার্থে আরও বেশি সময় পাওয়ার জন্য তরুণ-যুবক ও জনতাতে আরেকবার রাস্তায় নামতে হতে পারে-প্রস্তুত থেকো।
 
                            
                             
                                                                                                
 
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                    
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন