ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা :  ডিজিটাল যুগে জিহবার বিপদ

gbn

শায়খ সাইয়েদ আনিসুল হক ||

এই সপ্তাহে, আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে চাই যা নিয়ে আমরা সবাই, আমি নিজেও সংগ্রাম করি। এটি এমন কোনো অঙ্গ বা অভ্যাস নয় যা নিয়ে আমরা সবসময়ই ভাবি, কিন্তু এর প্রভাব সর্বত্র- তা হলো আমাদের জিহবা।

জিহ্বার গুরুত্ব বোঝাতে আমি একটি হাদিস দিয়ে শুরু করছি। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন: "হে আল্লাহর রাসূল, একজন নারী রাতে নামায পড়ে, দিনে রোজা রাখে, দান-খয়রাত করে, কিন্তু তার জিহ্বা দ্বারা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়।" নবী (সাঃ) বললেন, "তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।" এরপর লোকটি অন্য একজন নারীর বর্ণনা দিলেন, যে কেবল ফরয নামায আদায় করে এবং সামান্য কিছু দান করে, কিন্তু কাউকে কখনও কষ্ট দেয় না। তখন নবী (সাঃ) বললেন, "সে জান্নাতের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।"

এটি আমাদেরকে স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে আমাদের কথা বলার ধরনটা কতটা গুরুতর । কারণ এটি দেখায় যে, আমাদের সমস্ত ইবাদত আমাদের অসতর্কতার সাথে বলা কথার দ্বারা বাতিল হয়ে যেতে পারে । এই ছোট, হাড়বিহীন অঙ্গটি কাউকে জান্নাতে পৌছে দিতে পারে বা জাহান্নামে টেনে নামাতে পারে। আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে, এটি শুধু আমাদের মুখ দিয়ে বলা কথা নয় । আমাদের ফোন, আমাদের কীবোর্ড, আমাদের স্ক্রিন – এ সবই আমাদের জিহ্বার অংশ হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি মন্তব্য, একটি টুইট, একটি ম্যাসেজ, একটি ভয়েস নোট – এগুলোই এখন নতুন ধরনের কথা। আর এদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিও ঠিক ততটাই বাস্তব।

নবী (সাঃ) একবার একটি শক্তিশালী স্বপ্নের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির শাস্তির বর্ণনা দিয়েছেন, যার মিথ্যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল: একটি হুক দিয়ে বারবার তার মুখ ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছিল। এটি ভয়ঙ্কর। তবে এটি এমনই হওয়ার কথা। কারণ সত্য হলো, যখন আমরা আমাদের কথার ব্যাপারে অসতর্ক থাকি, তখন ক্ষতি আমাদের মধ্যেই থেমে থাকে না। এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখি যখন নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "তোমরা কি জানো অভাবী কে?" সাহাবারা উত্তর দিলেন, "যার কোনো অর্থ বা সম্পদ নেই।" কিন্তু নবী (সাঃ) বললেন, "আমার উম্মতের মধ্যে অভাবী সে, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা এবং যাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভোগ করেছে, কারো রক্ত ঝরিয়েছে এবং অন্যকে মেরেছে। তাদের প্রত্যেককে তার নেক আমল থেকে প্রতিদান দেওয়া হবে। যদি তার নেক আমল শেষ হয়ে যায় ন্যায়বিচার হওয়ার আগেই, তবে তাদের পাপ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।" এই হাদিসটি সত্যিই আমাদের থামিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। আমরা কত নামায পড়ি বা রোজা রাখি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদি আমরা আমাদের কথা এবং অন্যের প্রতি আমাদের আচরণে অসতর্ক থাকি। সবকিছুই গণ্য হয়। তাই আমি নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দেই: আমার কথার হেফাজত করা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা আমার নামাযের হেফাজত করা। এবং আমি আমাদের সবাইকে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে অনুরোধ করছি, ঠিক যেমন আমরা আমাদের অর্থ ও সম্পত্তির সুরক্ষা করি, তেমনি আমাদের জিহ্বারও সুরক্ষা করা প্রয়োজন। তাহলে কিভাবে আমরা এটি করব? প্রথমত: মুরাকাবা- সর্বদা সচেতন থাকা যে আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং শোনেন। ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রাহঃ) এটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আপনার ভেতরের চিন্তা এবং বাইরের কাজগুলি আল্লাহর নজরে সর্বদা রয়েছে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি পোস্ট, প্রতিটি কথোপকথন – সবই রেকর্ড করা হয়। দ্বিতীয়ত: কাছরাতুস সামত – নীরবতা বৃদ্ধি করা। এর অর্থ হলো, কথা বলার সুস্পষ্ট উপকার না থাকলে নিজেদেরকে চুপ থাকতে প্রশিক্ষণ দেওয়া। নবী (সাঃ) বলেছেন, "ভালো কথা বলো অথবা চুপ থাকো।" আমি এমন একটি ঘটনা বলতে চাই, যা আমার জন্য এটিকে খুব বাস্তব করে তুলেছিল। এক ঈদে, আমরা কয়েকজন মাসজিদের পুরনো একটি ভিডিও দেখছিলাম। প্রথমে আমরা কেবল হাসছিলাম এবং ভালো সময়গুলো স্মরণ করছিলাম, কিন্তু তারপর হাসিটা বদলে গেল। আমরা ভিডিওতে থাকা কিছু লোককে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই আমাদের এক ভাই, আল্লাহ তাঁর উপর রহমত করুন, হঠাৎ বললেন, "ভাইয়েরা, আমরা হয়তো গিবত করছি।" এভাবেই একটি হালকা মুহূর্ত পাপের দিকে মোড় নিয়েছিল।

তৃতীয়ত: জিহ্বাকে উপকারী কাজে ব্যস্ত রাখা – যিকির। নবী  (সাঃ) বলেছেন, "তোমার জিহ্বাকে আল্লাহর স্মরণে সিক্ত রাখো।" যদি আমরা এটিকে ভালো কাজে ব্যস্ত রাখি, তবে ক্ষতির সুযোগ কম থাকে। এই সপ্তাহের খুতবা শেষ করার আগে, আমি এমন একটি দুঃখজনক ঘটনা স্মরণ করতে চাই যা আমাদের কখনও ভোলা উচিত নয় – স্রেব্রেনিকার গণহত্যা। এর ৩০তম বার্ষিকী স্মরণে, আমরা স্মরণ করি কিভাবে ৮ হাজারের  বেশি মুসলিম পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছিল। ত্রিশ বছর পরেও, ব্যথা ঠিক ততটাই তাজা। আজও তাদের পরিবারগুলি শোক ও অবিচারের বোঝা বহন করছে। আর আজকের দিনে আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমাদের ফিলিস্তিনের ভাই-বোনেরা অকল্পনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে – বোমা হামলা, বাস্তুচ্যুতি, অনাহার এবং দখলদারিত্ব । আবারও বিশ্ব তাকিয়ে আছে।

হে আল্লাহ, আমাদের গুনাহ মাফ করুন এবং আমাদেরকে ভালো কথা বলার তাওফিক দিন । হে আল্লাহ, বসনিয়া ও ফিলিস্তিনের ভাই-বোনদের ওপর রহমত করুন । তাদের ন্যায়বিচার, শান্তি এবং বিজয় দান করুন । তাদের সম্মানের সাথে তাদের ঘরে ফিরিয়ে দিন । আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং আমাদের জিহ্বাকে আপনার যিকিরে সিক্ত রাখুন। আমিন।

শায়খ সাইয়েদ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। ১১ জুলাই ২০২৫

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন