সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি নারীদের বছরের পর বছর হেনস্তা করছিলেন এক ব্যক্তি। হাসান সাইদ নামের ওই বাংলাদেশি পুরুষ ফ্রান্সে থাকেন, এবং টিকটক ব্যবহার করে নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেন। খবর- বিবিসি
যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে বাস করেন সুলতানা (ছদ্মনাম)। নারীবিদ্বেষ এবং ক্ষতিকর সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি টিকটকে আলোচনা করতেন। ২০২১ সালে তার পরিচিত একজনকে হেনস্তা করতে শুরু করেন হাসান সাইদ। এর প্রতিবাদ করায় সুলতানাকেও হুমকিধমকি দিতে থাকেন সাইদ। টিকটকে হাসান সাইদের প্রচুর ফ্যান-ফলোয়ার আছে, তারাও সুলতানাকে হেনস্তা করতে থাকেন।
সুলতানা জানান, পরবর্তী দুই বছর বার বার তাকে হেনস্তা করেন সাইদ। এ ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।
যুক্তরাজ্যের আরও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন, হাসান সাইদ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তাদের ছবি চুরি করেন। এরপর টিকটকে গিয়ে সেই নারীর ছবি দিয়ে টিটকারি করতে থাকেন, কখনো ধর্ষণ এবং হত্যার হুমকি দেন।
হাসান সাইদের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিবিসি, কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।
যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে পরিবার নিয়ে বাস করেন মাসুমা। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি করার পাশাপাশি টিকটকে রান্নাবান্না দেখান এবং সেখানে তার একটি দোকানও আছে। একদিন হাসান সাইদ তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং মাসুমার টিকটক লাইভে অতিথি হিসেবে আসতে চান। মাসুমা তাকে প্রত্যাখ্যান করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সাইদ। মাসুমাকে ‘ঝুলিয়ে’ দেওয়ার হুমকি দেন তিনি।
মাসুমা এ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন টিকটকে, কিন্তু এরপর তাকে টার্গেট করেন সাইদ।
সে আমাকে নিয়ে ভিডিও বানায় আর বলে আমি একজন যৌনকর্মী, মাসুমা বিবিসিকে বলেন।
সাইদের ফলোয়াররা সেই ভিডিও শেয়ার করতে থাকে। এক পর্যায়ে টিকটক তা সরিয়ে নেয়, কিন্তু মাসুমা বলেন, ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। তার ব্যবসা এবং পেশা দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি পুলিশের কাছে যান, কিন্তু তারাও কিছু করতে পারেনি।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ারের বাসিন্দা কামরুল ইসলামের নজরে আসে হাসান সাইদের টিকটক অ্যাকাউন্ট। এমন ভয়াবহ সব টিকটক কেউ তৈরি করতে পারে, তিনি তা ভাবতেও পারেননি। বন্ধুবান্ধবদের থেকে তিনি জানতে পারেন, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীদের বেশ কয়েক বছর ধরেই টার্গেট করে আসছে সাইদ।
অনেক বেশি ফ্যান-ফলোয়ার রয়েছে তার, এ কারণে সাইদ ধরে নিয়েছেন তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। তাকে থামাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কামরুল।
প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে হাসান সাইদের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কামরুল। এতে হিতে বিপরীত হয়। কামরুল ও তার পরিবারের ছবি নিয়ে টিকটকে ছড়িয়ে দেন সাইদ, সরাসরি তার মা ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দিতে থাকেন। এ পর্যায়ে পুলিশ এবং টিকটক কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটি জানান কামরুল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, টিকটক বিষয়টিকে একেবারেই আমলে নেয়নি তখন। তারা জানায়, এই ভিডিওতে তাদের কমিউনিটি গাইডলাইনে কোনো ভায়োলেশন দেখে না তারা।
এরপর প্যারিসে যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন কামরুল। সেখানে একজন ফরাসি আইনজীবীর দ্বারস্থ হন তিনি। হাসান সাইদ ফরাসি আইনে লঙ্ঘন করে ধর্ষণ এবং সহিংসতার হুমকি দিয়েছেন, এ মর্মে তিনটি মামলা করা হয়। কিন্তু এ মামলাগুলো খুবই ধীরগতিতে চলছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের পুলিশি প্রক্রিয়াও ধীর। প্রায় আড়াই মাস সময় নিয়ে তারা কামরুলের অভিযোগ ইন্টারপোল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
সবশেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে কামরুল যুক্তরাজ্যের ইনফরমেশন কমিশনার’স অফিস (আইসিও) এর দ্বারস্থ হন। এখান থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। টিকটক, ফেসবুক, এবং ইউটিউবকে হাসান সাইদের কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার জন্য সাতদিন সময় দেওয়া হয়।
এতদিনে এসব প্ল্যাটফর্মের টনক নড়ে। টিকটক হাসান সাইদের অ্যাকাউন্ট ব্যান করে দেয়, তার ভিডিওগুলো সরিয়ে নেয়। ইউটিউব তার চ্যানেল মুছে ফেলে। ফেসবুক থেকেও তার কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়া হয়, তার পেইজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছেন। হাসান সাইদ বা অন্যান্য টিকটকারের হেনস্থার শিকার অনেক যুক্তরাজ্য প্রবাসী নারী তার সাথে যোগাযোগ করেছেন। এমন ভয়াবহ হেনস্থায় অনেকে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথাও ভেবেছেন।
সুলতানা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা নিজেদের কথা বলবেন, অনেক বাংলাদেশি পুরুষ তা পছন্দ করেন না। এ কারণে তারা নারীদের হেনস্থার মাধ্যমে চুপ করিয়ে রাখতে চান। এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের আরও নজর দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কামরুল জানান, এতকিছুর পরেও হাসান সাইদ দমে যাননি। টিকটকে নতুন নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে কামরুলের পরিবারকে হেনস্তা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন হাসান সাইদ। এ বিষয়ে প্রতিদিনই কামরুল টিকটকের সাথে যোগাযোগ করেন, কিন্তু সবসময় দ্রুত পদক্ষেপ নেয় না প্ল্যাটফর্মটি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন