শান্তির নোবেল গেল ইউক্রেন, বেলারুশ ও রাশিয়ায়

gbn

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  //

ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নাগরিক সমাজের মৌলিক অধিকার আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা এক মানবাধিকার কর্মী ও দুই মানবাধিকার সংস্থাকে চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় নরওয়ের রাজধানী অসলোতে নোবেল ইনস্টিটিউট শান্তির নোবেলজয়ী ব্যক্তি ও সংস্থার নাম ঘোষণা করেছে।

নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি বলেছে, বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি, রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনের মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিসকে চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

কমিটি বলেছে, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ীরা তাদের নিজ নিজ দেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা অনেক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষায় প্রচার চালিয়ে আসছে। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো বিষয়গুলো নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টার জন্যও শান্তির এই নোবেলজয়ীরা প্রশংসিত।

মানবতাবাদী মূল্যবোধ, সামরিকায়নবিরোধী এবং আইনের শাসনের জন্য ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরা দেশে দেশে আলফ্রেড নোবেলের শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার রূপকল্পকে পুনরুজ্জীবিত এবং সম্মানিত করেছেন; যা আজ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

নোবেল কমিটি বলছে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেলারুশে গণতন্ত্র আন্দোলনের সূচনাকারীদের একজন হলেন ২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি। নিজ দেশে গণতন্ত্রের প্রচার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি।

১৯৯৬ সালে ভিয়াসনা (বসন্ত) নামে একটি মানবাধিকার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি। পরে ভিয়াসনা ব্যাপক বিস্তৃত মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক বন্দীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত এবং এর প্রতিবাদ করে আসছে অ্যালেসের এই সংস্থা।

বেলারুশের সরকারি কর্তৃপক্ষ বারবার অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কির কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। ২০২০ সাল থেকে দেশটির কারাগারে বিনাবিচারে আটক রয়েছেন তিনি। প্রচন্ড ব্যক্তিগত দুর্দশা সত্ত্বেও অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি বেলারুশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক ইঞ্চিও ছাড় দেননি।

এবারে শান্তির নোবেলজয়ী রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মানবাধিকার কর্মীরা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন; যারা কমিউনিস্ট শাসনের নিপীড়নের শিকারদের কখনই ভুলে না যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

অতীতের অপরাধ মোকাবিলা নতুনকে প্রতিরোধ করার জন্য অপরিহার্য; এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল মেমোরিয়াল। সংস্থাটি সামরিকায়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে মানবাধিকার ও সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

চেচেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ান এবং রুশপন্থী বাহিনী জনগণের ওপর যে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল, সেসবের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করেছে মেমোরিয়াল। ২০০৯ সালে চেচনিয়ায় মেমোরিয়াল শাখার প্রধান নাতালিয়া এস্তেমিরোভা সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে খুন হন।

অন্যদিকে, এ বছর যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ইউক্রেনের মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস দেশটিতে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইউক্রেনীয় সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করা এবং ইউক্রেনকে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দেশে পরিণত করার জন্য কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী এক শক্তি হিসেবে কাজ করছে সংস্থাটি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের জনগণের ওপর রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ শনাক্ত ও নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস।

শান্তিতে নোবেলজয়ী নির্বাচনের দায়িত্ব নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির। সব নোবেল পুরস্কার সুইডেনের স্টকহোম থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও শান্তি পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয় নরওয়ের অসলো থেকে। কাজটি আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী করা হয়।

পুরস্কার হিসেবে ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার ভাগাভাগি করে নেবেন শান্তিতে এই নোবেলজয়ীরা। এর আগে, গত বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দুই সাংবাদিক। তারা হলেন ফিলিপিনো সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ।

সাহসিকতার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় তাদের।

১৯০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ১০২ বার। এর মধ্যে বিশ্বের সংকটপূর্ণ নানা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২৫ বার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থাকে।

নোবেলের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দুবার তিন ব্যক্তি যৌথভাবে শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া এখন পর্যন্ত শান্তির নোবেল পেয়েছেন ১৮ জন নারী। তবে নোবেলে শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন লি ডাক থো।

এ বছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণা শুরু হয় গত ৩ অক্টোবর (সোমবার)। প্রথমদিন চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। বিলুপ্ত হোমিনিনের জিন ও মানব বিবর্তনের যুগান্তকরী এক গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পেয়েছেন সুইডিশ জিনতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো।

মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে পদার্থবিজ্ঞানে তিন নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন, ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জন এফ ক্লজার ও অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্টন জেলিঙ্গার। নোবেল কমিটি বলেছে, বেল ইনেকুয়ালিটির পরীক্ষায় পাওয়া প্রমাণ ও কোয়ান্টাম অ্যান্টেঙ্গেলমেন্ট গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য তাদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

বুধবার ঘোষণা করা হয় রসায়নের নোবেল। ক্লিক রসায়ন এবং বায়োঅর্থোগোনাল রসায়নে অবদান রাখায় এ বছর রসায়নে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ক্যারোলিন আর. বারতোজ্জি, ডেনমার্কের মর্টেন মেলডাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কে. ব্যারি শার্পলেস।

আগামী ১০ অক্টোবর অর্থনীতিতে বিজয়ী ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হবে এবারের নোবেল পুরস্কারের আনুষ্ঠানিকতা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ছোট পরিসরে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে আয়োজক কমিটির বাইরে অন্য কোনো অতিথি উপস্থিত ছিলেন না।

এ বছর তাই নোবেল ফাউন্ডেশন ২০২২ সালের বিজয়ীদের সঙ্গে গত দুই বছরের বিজয়ীদেরও ডিসেম্বরের নোবেল সপ্তাহে আমন্ত্রণ জানাবে। সেখানে ১০ ডিসেম্বর নোবেল পুরস্কারের অর্থের (১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার) পাশাপাশি বিজয়ীদের হাতে সনদ ও স্বর্ণপদক তুলে দেওয়া হবে।

উনবিংশ শতাব্দীতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক, যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে যান— প্রতি বছর ৫টি বিষয়ে যারা বিশেষ আবদান রাখবেন তাদের যেন এই অর্থ থেকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওই ৫ বিষয় হলো— চিকিৎসা, পদার্থ, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তি। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয় নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় অনেক পরে ১৯৬৮ সালে। ব্যাংক অব সুইডেন আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে এই পুরস্কার চালু করে।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন