গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদ চেষ্টা বন্ধে ৪০ নাগরিকের বিবৃতি

ছাদেকুল ইসলাম রুবেল,গাইবান্ধাঃ

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (বাগদা) ফার্মের জমিতে ইপিজেড স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে ফার্মের সাঁওতাল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্প্রতি একটি সভা করেছেন বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, স্থানীয় সাংসদ, গাইবান্ধার এসপি, গোবিন্দগঞ্জের মেয়র। সাঁওতাল নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই সভায় তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতালরা বিক্ষোভও করেছেন। এ প্রসঙ্গে সাঁওতালদের উচ্ছেদ চেষ্টা বন্ধে ৪০ নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন।

 

গত ১০ মে (মঙ্গলবার) গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাঁওতাল নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠে।

 

এ প্রসঙ্গে বিবৃতিতে নাগরিকরা বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সূত্র থেকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমরা জানতে পেরেছি যে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (বাগদা) ফার্মের জমিতে ইপিজেড স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১০ মে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, স্থানীয় সাংসদ, গাইবান্ধার এসপি, গোবিন্দগঞ্জের মেয়রসহ বাগদা ফার্মের সাঁওতাল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি সভায় মিলিত হয়েছিলেন। অথচ সাঁওতাল নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদেরকে উক্ত সভায় তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে, এর প্রতিবাদে স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতালরা বিক্ষোভও করেছেন। তাদের দাবি চিনিকলের জন্য আখ চাষ করা ছাড়া অন্য কিছু করা হবে না- এই শর্তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এসব জমি রিকুইজিশন করেছিল। চিনিকলটি ২০০৪ সাল থেকে বন্ধ থাকায় সে শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, তাই জমিগুলো তাদের কাছে ফেরৎ দিতে হবে।

 

বিবৃতিতে নাগরিকরা আরও বলেন, ইপিজেড নির্মাণের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা মনে করি তাদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত এবং কোনো অবস্থায়ই তিন ফসলী জমিতে ইপিজেড স্থাপন করা কিংবা কোনো শিল্প কারখানা করা যাবে না- এই মর্মে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও আছে।

 

স্থানীয় সাঁওতালদের দাবি, রিকুইজিশন করা ১৮৪২ একর জমির সঙ্গে তাদের আরো প্রায় ৬০০ একর জমি ফার্মের নামে অবৈধভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে। এক পর্যায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের একাংশের যোগসাজসে এবং অসৎ সুগার মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বাগদা ফার্ম এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় এবং উচ্ছেদের নামে তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। ফলে ৩ জন আদিবাসী সাঁওতাল নিহত হন। কিছু পুলিশ সদস্য ও দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে সাঁওতালদের সহস্রাধিক বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়। এ সংক্রান্ত হত্যা মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। গভীর উদ্বেগ ও পরিতাপের বিষয় যে, ইপিজেড স্থাপনের নামে আবার ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় সাঁওতালদের ঐ এলাকা থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদের নয়া কোনো পরিকল্পনার ছক কাঁটা হচ্ছে বলে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

 

বিবৃতিতে বলা হয়, গত এক দশকে আমরা সবাই জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ বার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, কোনো দুই বা তিন ফসলী কৃষিজমি অকৃষিজ ব্যবহারের জন্য অধিগ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু স্থানীয় এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্ত চক্র এবং প্রশাসনের উচ্চাভিলাসী অসৎ কিছু কর্মকর্তা এ ঘটনার নেপথ্যে থেকে বিভিন্ন দুষ্কর্ম ও অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং তাদেরই অতি উৎসাহী তৎপরতার কারণে সরকারি উদ্যোগ ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে। ইপিজেড করতে হলে সেটির জন্য সরকারের জায়গার অভাব নেই। কারণ এর আগে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর সাকোয়া নামক স্থানে সরকারি খাসজমিতে ইপিজেড করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। সুতারাং সেই জায়গায় ইপিজেড না করে বাগদা ফার্মের তিন ফসলী জমিতে ইপিজেড নির্মাণের চেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা লংঘন করার সামিল।

 

এ পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা স্পষ্ট ভাষায় ইপিজেড কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য কৃর্তপক্ষকে এ ধরণের জনবিরোধী, উস্কানিমূলক ও হঠকারী উচ্ছেদ পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য আহবান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি কোনো চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য সিদ্ধান্তের ফল কখনও ভাল হয় না। একই সঙ্গে বিষয়টির প্রতি আমরা সরকারের বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং তারই বহুল-উচ্চারিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাগদা ফার্মের তিন ফসলী কৃষিজমি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পূর্বতন মালিকদের বংশধরদের অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাই।

 

এই বিবৃতিতে যাঁরা স্বাক্ষর করেন- পঙ্কজ ভট্টাচার্য, হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, আলী ইমাম মজুমদার, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, খুশী কবির, আনু মুহাম্মদ, জেড আই খান পান্না, আবুল বারকাত, শাহীন আনাম, শিরিন হক, পারভীন হাসান, ইফতেখারুজ্জামান, মেঘনা গুহঠাকুরতা, রানা দাশগুপ্ত, রিজওয়ানা হাসান, সুব্রত চৌধুরী, কাজল দেবনাথ, তবারক হোসেইন, শহিদুল আলম, রাহনুমা আহমেদ, শারমিন মোর্শেদ, গীতি আরা নাসরিন, সুমাইয়া খায়ের, রোবায়েত ফেরদৌস, তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সামিনা লুৎফা, সঞ্জীব দ্রং, নুর খান, জোবায়দা নাসরিন, মোহম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, জাকির হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, রেজাউর রহমান, হানা শামস আহমেদ, দীপায়ন খীসা, অনুপ রাহী, নোভা আহমেদ, পল্লব চাকমা, শামসুল হুদা

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন