দে লো য়া র জা হি দ ||
বাংলাদেশ ধর্মের নামে সাম্প্রতিক সময়ে এমন সব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে আসছে যা নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, অসাংবিধানিক, লজ্জাস্কর ও দুর্ভাগ্যজনক। দেশে মৌলবাদী শক্তি তাদের অবস্থানকে অনেক পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী হয়তো বড় রকমের সহিংস কোনো ঘটনা ঘটাতে পারছে না তবে এরা ‘রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভেতর অনুপ্রবেশ করতে ও সমর্থ হয়েছে। সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষক, শিল্পী ও সাধারণ মানুষকে নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় মূল চারনীতি যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্মারক তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে অগ্রাহ্য ও অবমাননা করছে। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুধ্য়ে ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগ এনে তাকে সুপরিকল্পিত ভাবে হয়রানিমূলক ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।
‘শিশু-কিশোরদের অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক পাঠদানই এ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে দেশের শিক্ষাধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমতার সমাজ গড়ার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে পাঠ্যসূচি থেকে যে কোনো ধরনের ‘ঘৃণা সঞ্চারী’ রচনা বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছেন দেশের ১৮ বিশিষ্ট নাগরিক।
দৈনিক শিক্ষায় একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘আমরা হৃদয় মণ্ডলের নিঃর্শত মুক্তি দাবি করছি। আর যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে তাঁদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। বিবৃতিদাতারা হলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, সারওয়ার আলী, আবেদ খান, সেলিনা হোসেন, লায়লা হাসান, আবদুস সেলিম, মফিদুল হক, শফি আহমেদ, শাহরিয়ার কবীর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুনতাসীর মামুন, সারা যাকের, শিমূল ইউসুফ ও হারুন হাবীব।---বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলা নববর্ষের প্রভাতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিদাত বলে ঘোষণা আমাদের মনে এই ছায়াপাত করে যে, রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী শক্তি তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে যা সামাজিকভাবে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।’
খবরে প্রকাশ এ র আগে গত ২০ মার্চ বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির মানবিক শাখার ক্লাস নেওয়ার সময় হৃদয় মণ্ডল ‘ধর্ম অবমাননা’ করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনায় ২২ মার্চ মামলা করেন স্কুলের অফিস সহকারী মো. আসাদ। সেদিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। জানা গেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নেতাদের দাবি শিক্ষক হৃদয় মন্ডল তার ক্লাসে; প্রাসঙ্গিকভাবে বিজ্ঞানের মৌলিক কিছু বিষয় এবং ধারণা তুলে ধরেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুধ্যে ধর্ম অবমানার অভিযোগ তোলা হলো --- স্কুলের প্রধান শিক্ষক সামাজিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করলেন এবং পুলিশ শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে আটক করলো। আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা এমনিতেই দুর্বল। যতটুকু হচ্ছে সেখানেও বিজ্ঞানমনস্কতা জায়গা করতে পারছে না। ফলে বিজ্ঞানের মৌলিক দিক, নতুন-নতুন গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অভাবে শিক্ষার্থীরা সমাজ, সমাজের সংকট এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্ধ বিশ্বাস এবং ভয়ের পরিবেশ বাড়তে থাকলে সংকট আরও ঘনীভূত হতে থাকবে।
শুধু ভারত বা বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে পণ্ডিত ও বিষয়-বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রদায়িকতাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং, এই সমস্ত সংজ্ঞা, দুর্ভাগ্যবশত, স্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িকতার সম্পূর্ণ অর্থ বা অনুভূতি প্রকাশ করে না। যাইহোক, রিচার্ড সি. ল্যামবার্ট, যিনি দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি অনুসারে সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার অবস্থান সম্পর্কে আমাদের একটি সঠিক চিত্র প্রদান করেছেন।
সে অর্থে একথা স্পষ্ট যে সাম্প্রদায়িকতার চারটি প্রধান বিষয় আমাদের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে আর তা হলো নেতিবাচকতা; সংকীর্ণতা;অন্যায় মানে; এবংসমাজের স্বার্থকে উপেক্ষা করা। সাম্প্রদায়িকতা সমস্যার এ বীজ বপন হয়েছে ১৯ শতকে, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকদের আমল থেকে এবং বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়েও নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর এক শ্রেণীর মানুষ।
মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাঁর গ্রেপ্তারে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন এখন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রগতিশীল সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যেন ক্লুপ দিয়েছে, এখানেই সাম্প্রদিকতাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়ার জায়গা। দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে লালনের মাঝে আমরা ঘৃণার সংস্কৃতি চালু করেছি। যার বিকল্প বা সাধারণ প্রতিশব্দ হল ঘৃণা, ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা। এরকম একটি মানসিক বিদ্বেষ এর শিকার হয়েছেন বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। একটি পরিকল্পিত শত্রুতা বা বিদ্বেষের আশু সমাপ্তি ঘটাতে সরকার ব্যর্থ হলে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে মুক্ত করতে দেশে বিদেশে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে।
লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অফ ম্যানিটোবা, সাবেক বোর্ড অব ডিরেক্টরস মেম্বার প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন