আব্দুর রহমান, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালের ১৩, ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারির কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সভাপতি নির্বাচিত হবার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন দেশে ফিরে আসবেন বলে ঘোষণা করেন, তখন হন্তারক জিয়াউর রহমান তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সংকল্প , তাঁর দেশে ফেরার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণে জিয়াউর রহমান তাঁকে দেশে আসতে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতার জাল ছিন্ন করে ১৯৮১ সালের ১৭মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শুধু তাই নয় দেশে আসার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্বজনদের রক্তে রাঙানো ৩২ নম্বর বাড়িতে মিলাদ পড়াতে চেয়েছিলেন। জিয়া সে অনুমতিও দেয়নি। বাধ্য হয়ে রাস্তায় শামিয়ানা টাঙিয়ে মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনই প্রতিহিংসাপরায়ন ছিল জিয়াউর রহমান। সেদিন উপস্থিত নেতাকর্মীরা শ্লোগান দিয়েছিল এই বলে- 'ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, শেখ হাসিনা, আমরা আছি তোমার সাথে।'
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। পশ্চিম জার্মানি থেকেই স্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং শিশু পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও শিশু কন্যা সায়মা ওয়াজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী খ্যাতিমান পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের যাত্রার বিষয়টি সে সময় গোপন রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ২৫ আগস্ট সকালে দিল্লি পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান। বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নয়া দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। ওই বাসায় ছিল একটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দুটো বেডরুম। তাদের জন্য পরামর্শ ছিল এমন- বাসার বাইরে না যাওয়া, ওখানকার কারো কাছে পরিচয় না দেওয়া এবং দিল্লির কারো সাথে যোগাযোগ না রাখা।
ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এক রকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়া ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে থেকেই শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে পারেন। পরে শেখ হাসিনা জন্য ইন্ডিয়া গেইটের কাছে পান্ডারা পার্কের ‘সি' ব্লকে একটি ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য দুজন নিরাপত্তরক্ষীও দেওয়া হয়। # ১৬ মে শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকালে তাঁরা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। সেদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা জড়ো হয়েছিল তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বিমানবন্দর এলাকা। ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব।’, ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল এলাকা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে স্বদেশে পা রাখেন। তখন ক্ষমতার দখলদার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকেই বন্দুকের নলে হত্যা করে স্বৈরতন্ত্র চালু করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে নতুন করে পাকিস্তানি আদর্শে পরিচালনা করছিলেন। তাই ১৭ মে ১৯৮১ সালে শুধুই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল না, এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, বিচারহীনতা ও উন্নয়নের 'স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।'
বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া এভিনিউতে, সেখানে লাখো জনতার সামনে শেখ হাসিনা হৃদয়বিদারি কণ্ঠে বলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।"
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর থেকে বিএনপি-জামাত, স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে বারবার। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বৃষ্টির মতো গ্রেনেড ছুঁড়েও তাঁকে হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয়। সর্বশেষ গত ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘উত্তরণ’ এর রিপোর্টে প্রকাশিত হয়। এরপরও তাকে বহনকারী বিমানে দু’বার নাশকতার চেষ্টা হিসেবে ধরলে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় মোট ২১ বার। বারবার মৃত্যুর উপত্যকা থেকে ফিরেও মৃতুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা বিচলিত নন, দ্বিধান্বিত নন, বরং নতুন উদ্যামে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সব প্রতিবন্ধকতা সমস্যা-সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু-ইকোনমির নবদিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, সাবমেরিন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করণ, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই প্রদান, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সন্ত্রাস এবং জঙ্গি দমনেও সফল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এছাড়া মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার ঝুলিতেও জমেছে অনেক অর্জন। এ পর্যন্ত শেখ হাসিনা অর্জিত আন্তর্জাতিক পদক ও পুরস্কারের সংখ্যা ৩৯টি।
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় শেখ হাসিনার নেওয়া পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস’ বিশ্বের পাঁচজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এই পাঁচজন সরকারপ্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কই নন, তিনি তার সততা, যোগ্যতা ও কর্ম প্রচেষ্টায় আজ বিশ্বনেত্রী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে একজন অনুকরণীয় নেতৃত্বের আদর্শ।
#সৈয়দ নাজমুল হাসান, ঢাকা ||
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন