হুসনা খান হাসি॥
মেনোপজ একজন নারীর জীবনের স্বাভাবিক একটি ধাপ, যেন ধীরে ধীরে একটি অধ্যায় শেষ হয়ে আরেকটি অধ্যায়ে পা রাখা। এটি কোনো অসুখ নয়, বরং একটি জৈবিক পরিবর্তন যা প্রজননক্ষম সময়ের সমাপ্তি নির্দেশ করে। কারও জন্য এটি আসে নীরবে, সামান্য অনিয়মিত ঋতুচক্র বা মাঝেমধ্যে রাতের ঘামে ভিজে ওঠা দিয়ে। আবার কারও জন্য এটি যেন ঝড়ের মতো, হঠাৎ করে শরীর জুড়ে গরম ঢেউ বয়ে যাওয়া, নির্ঘুম রাত, মেজাজের ওঠানামা এবং শক্তির মাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই যাত্রা একদিকে শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে আসে, অন্যদিকে মানসিকভাবে নিজের শরীরকে কমে আসা ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় দেয়।
এই অস্বস্তিকর উপসর্গগুলো কমাতে অনেক নারী আশ্রয় নেন হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা এইচআরটি-র। ধারণাটি সহজ, শরীর যে হরমোনগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে আর তৈরি করছে না, সেগুলো বাইরে থেকে সরবরাহ করা। ট্যাবলেট, প্যাচ, জেল বা ছোট ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে ইস্ট্রোজেন, কখনও কখনও প্রোজেস্টেরনের সঙ্গে মিলিয়ে, শরীরে প্রবেশ করানো হয়। অনেক নারীর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন জীবন বদলে দিতে পারে। ঘুম ফিরে আসে, হট ফ্ল্যাশ কমে যায়, মেজাজ স্থিতিশীল হয়, আর প্রতিদিনের জীবন আবার নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে।
হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, বা সংক্ষেপে HRT, এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা শরীরে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আর তৈরি না হওয়া হরমোন পূরণ করে। এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় মেনোপজ-অভিজ্ঞ নারীদের ক্ষেত্রে, যে সময়ে ডিম্বাশয় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। অনেক নারীর জন্য এটি জীবন বদলে দেওয়া চিকিৎসা হতে পারে, তবে এরও রয়েছে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ছোট-বড় উভয়ই, যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা জরুরি।
তবুও, প্রকৃতির বিন্যাসে হস্তক্ষেপের মতো, এখানেও কিছু মূল্য আছে। সবার ক্ষেত্রে HRT-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এক নয়। কিছু নারীর ক্ষেত্রে শুরুর সপ্তাহগুলোতে দেখা দেয় ছোটখাটো অস্বস্তি, স্তনে টান, পেটে ভারী লাগা, বা মাথাব্যথা যা ধীরে ধীরে কেটে যায়। মুড পরিবর্তনও হতে পারে, কখনও অচেনা ধরনের আবেগের ওঠানামা। সময়ের সাথে সাথে শরীর ধীরে ধীরে নতুন ছন্দে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এসব উপসর্গ কমে আসে।
তবে এসব প্রাথমিক অসুবিধার বাইরে আছে কিছু জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। ট্যাবলেট আকারে নেওয়া ওরাল HRT পায়ে বা ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। প্যাচ বা জেলের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি কম, কিন্তু পুরোপুরি নেই না। এছাড়া স্ট্রোকের ঝুঁকি সামান্য বেড়ে যায়, বিশেষত বয়স্ক বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা নারীদের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে আলোচিত ঝুঁকির মধ্যে একটি হলো স্তন ক্যান্সার, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কম্বাইন্ড HRT ব্যবহার করলে এই ঝুঁকি সামান্য বাড়ে, যদিও সামগ্রিক ঝুঁকি এখনো তুলনামূলকভাবে কম। কেবল ইস্ট্রোজেন ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি এতটা নয়, তবে অন্যান্য সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়।
আরেকটি বিষয় হলো জরায়ুর আস্তরণের স্বাস্থ্য। যেসব নারীর জরায়ু অক্ষত আছে, তারা যদি প্রোজেস্টেরন ছাড়া ইস্ট্রোজেন নেন, তাহলে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সাধারণত কম্বাইন্ড থেরাপি দেওয়া হয়, যদি না সার্জারির মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করা হয়ে থাকে। এমনকি গলব্লাডারের মতো অবহেলিত অঙ্গও প্রভাবিত হতে পারে, ওরাল HRT পাথর বা প্রদাহের ঝুঁকি বাড়ায়, যা কখনও কখনও অস্ত্রোপচার পর্যন্ত গড়ায়।
এই ঝুঁকিগুলো বাস্তব, কিন্তু উপকারও বাস্তব। অচিকিৎসিত মেনোপজ শুধু অস্বস্তি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি হাড় ক্ষয় ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ায়। HRT হাড়ের শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে, অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়। কিছু প্রমাণ আছে যে এটি অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকিও সামান্য কমাতে পারে। HRT শুরু করার সিদ্ধান্ত কখনো সহজ হয় না, এটি রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে, শরীর ও মনের মধ্যে, জীবনের মান ও ঝুঁকি গ্রহণের মধ্যে একটি আলাপচারিতা।
যা সিদ্ধান্তকে আরও ব্যক্তিগত করে তোলে তা হলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কেবল কাগজে লেখা উপসর্গ নয়, এগুলো জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। কেউ হয়তো ভাববেন সামান্য স্তন ব্যথা নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের জন্য ছোট্ট মূল্য। আবার কেউ হয়তো মনে করবেন সামান্য রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি গরম লাগা থেকে মুক্তির চেয়ে বড়। কেউ হয়তো এক সময় HRT চেষ্টা করবেন, তারপর বন্ধ করে নতুন করে নিজের শরীরের পরিবর্তন সামলানো শিখবেন, বাড়তি সহায়তা থাক বা না থাক।
তবে মনে রাখা দরকার, মেনোপজ শুধুই উপসর্গের গল্প নয়। এটি এমন এক সময় যা আত্ম-যত্ন, নতুন অগ্রাধিকার এবং জীবনযাত্রায় ভিন্ন ছন্দ আনার সুযোগ দেয়। এইচআরটি কার্যকর হলেও এটি একমাত্র পথ নয়। নিয়মিত ব্যায়াম, ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য এবং যোগ বা ধ্যানের মতো চাপ-হ্রাসকারী অভ্যাসও শরীরকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারে। কেউ কেউ প্রাকৃতিক উপায় বেছে নেন বা কেবল সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনটিকে মেনে নেন, বিশ্বাস করেন যে শরীর একসময় নিজস্ব ভারসাম্যে পৌঁছাবে।
শেষ পর্যন্ত, HRT না কোনো অলৌকিক সমাধান, না কোনো ভয়ংকর বিপদ। এটি একটি হাতিয়ার, আর সব হাতিয়ারের মতোই এর মূল্য নির্ভর করে কখন এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে, এবং ব্যবহারকারী এর সীমা ও সম্ভাবনা কতটা বোঝেন তার ওপর। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনে করিয়ে দেয় যে চিকিৎসায় যেমন, জীবনের ক্ষেত্রেও, প্রতিটি লাভের একটি ছায়া থাকে, আর প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী। HRT-এর আলাপ কেবল হরমোন নয়, বরং আত্মসচেতনতা, চিকিৎসকের প্রতি আস্থা, আর নিজের স্বাস্থ্যযাত্রার দায়িত্ব নেওয়ার সাহসের কথাও বলে।
HRT নেওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল চিকিৎসাগত নয়, এটি গভীরভাবে ব্যক্তিগতও বটে। সৎভাবে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা, নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ, এবং সময়ে সময়ে পুনর্বিবেচনা, সবই জরুরি। মেনোপজ জীবনীশক্তির শেষ নয়, বরং নতুন এক ছন্দের শুরু, যা গ্রহণ করা যায় জ্ঞান, যত্ন এবং নিজের সিদ্ধান্তে আস্থার সঙ্গে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন