হুসনা খান হাসি॥
আমাদের সমাজে যখনই “মেনোপজ” শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখন সবার প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নারীর জীবনের এক বিশেষ পর্যায়। এটি নারীর জন্য একটি প্রজনন-সমাপ্তির সময়কাল, যা নানা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে নতুন জীবনযাত্রায় প্রবেশ করায়। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা প্রায়শই এড়িয়ে যাই যে, পুরুষদের জীবনেও একটি তুলনামূলক ধীরগতি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হরমোনাল পরিবর্তনের অধ্যায় রয়েছে, যাকে বলা হয় অ্যান্ড্রোপজ।
যদিও এটি নারীর মেনোপজের মতো আকস্মিক ও নির্দিষ্ট নয়, তবে পুরুষদের হরমোন টেস্টোস্টেরনের হ্রাস ধীরে ধীরে নানা পরিবর্তন ডেকে আনে। এ পরিবর্তনকে অনেকেই স্বীকার করতে চান না, কারণ পুরুষত্বের প্রচলিত ধারণা দুর্বলতা ও পরিবর্তনকে মেনে নিতে বাধা দেয়। ফলে অ্যান্ড্রোপজ কেবল একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা নয়, বরং এটি সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একটি জটিল বাস্তবতা।
দৈহিক প্রেক্ষাপট
অ্যান্ড্রোপজ মূলত শরীরে টেস্টোস্টেরনের স্তর ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ার ফল। এই পরিবর্তন সাধারণত ৪০ বছরের পর থেকে শুরু হয় এবং ৫০–৬০ বছরে এসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১-শারীরিক শক্তি ও সহনশীলতার হ্রাস: পুরুষরা লক্ষ্য করেন যে, তারা আগের মতো ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারেন না। সহজ কাজেও দ্রুত অবসাদ এসে যায়। শরীরে পেশিশক্তি কমতে থাকে, যা অনেককে মনে করায় যে তারা আর “পুরুষালী” নন।
২-যৌন ক্ষমতার পরিবর্তন: সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো যৌন স্বাস্থ্যের পরিবর্তন। যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস, ইরেক্টাইল সমস্যার উদ্ভব কিংবা তৃপ্তি কমে যাওয়া পুরুষদের মানসিকতায় গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ নিয়ে তারা প্রায়ই মুখ খোলেন না।
৩-শরীরের গঠনগত পরিবর্তন: পেশি কমে চর্বি জমা বাড়তে থাকে। কোমর ও পেটের আশেপাশে চর্বি জমার প্রবণতা দেখা যায়। হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় হাড় ভাঙার ঝুঁকিও বাড়ে।
৪-ঘুম ও ক্লান্তি: ঘুমের মান খারাপ হয়। অনেকেই অনিদ্রা, ঘন ঘন জেগে ওঠা বা সারাদিন ঘুমঘুম ক্লান্তি অনুভব করেন।
মানসিক প্রেক্ষাপট
অ্যান্ড্রোপজ শুধু শরীরের পরিবর্তন নয়, মনের ভেতরেও অস্থিরতার জন্ম দেয়।
১-মুড পরিবর্তন: হঠাৎ হঠাৎ রাগ, বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ কিংবা অস্থিরতা দেখা দেয়। পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে ছোটখাটো বিষয়েও তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন।
২-আত্মসম্মান ও পরিচয়ের সংকট: পুরুষত্বের প্রচলিত ধারণা শক্তি, যৌন ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতার ওপর দাঁড়ানো। যখন শরীর এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়, তখন অনেক পুরুষ নিজের পরিচয় নিয়ে প্রশ্নে পড়েন। “আমি কি আগের মতো আর নেই?” এই প্রশ্ন মানসিক অশান্তি বাড়ায়।
৩-অস্তিত্বের সংকট ও একাকিত্ব: সন্তানরা বড় হলে, পরিবারে ভূমিকা বদলালে, পেশাগত জীবনের সীমাবদ্ধতা দেখা দিলে পুরুষরা নিজেদের প্রান্তিক বা অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করেন। এই মানসিক চাপ অ্যান্ড্রোপজের শারীরিক সমস্যাকে আরও তীব্র করে তোলে।
সামাজিক প্রেক্ষাপট
অ্যান্ড্রোপজকে ঘিরে সমাজে প্রচুর ভুল ধারণা ও মিথ প্রচলিত।
১-“পুরুষরা দুর্বল হয় না” মিথ: পুরুষদের শক্তিশালী ও অপরিবর্তনীয় ভাবার প্রবণতা এতটাই গভীর যে, তাদের হরমোনাল বা মানসিক দুর্বলতাকে সমাজ সহজে স্বীকার করে না। ফলে তারা নীরবে কষ্ট সহ্য করে যান।
২-যৌনতার সাথে পুরুষত্বের সমীকরণ: যৌন ক্ষমতা কমে গেলে সমাজ মনে করে পুরুষত্বও কমে গেছে। এই সামাজিক চাপ পুরুষদের চিকিৎসা নিতে বা সমস্যার কথা বলতে নিরুৎসাহিত করে।
৩-“এটা আসলে নেই” ধারণা: অনেকেই মনে করেন অ্যান্ড্রোপজ বলে কিছু নেই, এটি কেবল মধ্যবয়সী পুরুষদের মনগড়া সমস্যা। ফলে সচেতনতা বাড়ে না, বরং উপেক্ষা বাড়ে।
৪-চিকিৎসা ও আলোচনা নিয়ে ট্যাবু: নারীরা যেমন মেনোপজ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন, পুরুষরা তেমন পারেন না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা পারিবারিক আলাপে এ বিষয়টি এখনো নিষিদ্ধের মতো।
প্রচলিত মিথ ভাঙার প্রয়োজন
অ্যান্ড্রোপজ নিয়ে আলোচনাকে স্বাভাবিক করা জরুরি। মিথগুলো ভাঙতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে: শিক্ষা ও সচেতনতা: স্কুল, পরিবার ও গণমাধ্যমে পুরুষদের বার্ধক্য ও হরমোনাল পরিবর্তন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা। চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা: হরমোন পরীক্ষা ও চিকিৎসা পদ্ধতির সহজলভ্যতা। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন: পুরুষত্বকে কেবল শক্তি বা যৌন ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, মানসিক ভারসাম্য, সহমর্মিতা ও আত্ম-গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া পরিবারের ভূমিকা: পরিবার যদি এ সময় পুরুষকে বোঝে ও সমর্থন দেয়, তবে পরিবর্তন মেনে নেওয়া অনেক সহজ হয়।
অ্যান্ড্রোপজ সামলানোর উপায় অ্যান্ড্রোপজ কোনো রোগ নয়, বরং জীবনের স্বাভাবিক একটি অধ্যায়। তবে কিছু জীবনধারার পরিবর্তন এটিকে অনেক সহজ করে তুলতে পারে।
১-সুষম খাদ্য ও নিয়মিত ব্যায়াম: শরীরচর্চা টেস্টোস্টেরন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য শরীরকে স্থিতিশীল রাখে।
২-মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: প্রয়োজনে কাউন্সেলিং, সাপোর্ট গ্রুপ বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া।
৩-চিকিৎসকের পরামর্শ: টেস্টোস্টেরন হ্রাস বেশি হলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হরমোন থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪-পরিবার ও সামাজিক সমর্থন: পরিবার যদি পুরুষের এই পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, তবে মানসিক চাপ অনেকটা হ্রাস পায়।
সব শেষে, অ্যান্ড্রোপজকে ঘিরে থাকা নীরবতা ও ভুল ধারণা পুরুষদের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু। নারী মেনোপজ নিয়ে যেমন খোলামেলা আলোচনা সম্ভব হয়েছে, পুরুষদের ক্ষেত্রেও তেমন আলোচনা জরুরি। এটি নিয়ে লজ্জা নয়, বরং সচেতনতা ও গ্রহণযোগ্যতা দরকার।
অ্যান্ড্রোপজ মানে পুরুষত্বের সমাপ্তি নয়, বরং জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায়। এই পরিবর্তনকে যদি আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি, তবে পুরুষরা কেবল সুস্থ থাকবেন না, বরং নিজেদের ভেতরে নতুন অর্থও খুঁজে পাবেন।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন