যখন যে সরকার, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তার—এটাই যেন রাষ্ট্রীয় চ্যানেলটির অলিখিত নিয়ম। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সেক্টরের মতো নিয়ম মেনে খোলস বদলেছে বিটিভিও। কতটা বদলাল? তার খতিয়ান তুলে ধরেছেন কামরুল ইসলাম।
একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।
জুলাইয়ে যখন দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরালো হচ্ছিল, তখন বিটিভির সামনেও শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিল। বিটিভি থেকে একদল নিয়মিত শিল্পী-কলাকুশলী বেরিয়ে আসছিলেন, তাঁদের দেখে শিক্ষার্থীরা কটাক্ষ করে বলছিল, ‘ওই দ্যাখ, বাতাবি লেবু! বাতাবি লেবু যায়।’ এটাই প্রথম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই বিটিভির সমার্থক শব্দ ‘বাতাবি লেবু’। দেশের নানা অসংগতি, অনিয়ম, দুর্নীতির মধ্যেও চ্যানেলটি ছিল নির্বিকার।
শুধু উন্নয়ন আর কৃষিতে বাম্পার ফলনের চিত্র দেখানো হতো। সে কারণেই দর্শকের দেওয়া এই নাম—‘বাতাবি লেবু’।
বিটিভির শুরুটা ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের পূর্ব পাকিস্তান বিভাগ হিসেবে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এটি বিটিভি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বরাবরই ক্ষমতাসীন সরকারের পরিকল্পনা ও নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয় বিটিভি।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে চ্যানেলটির প্রশাসনিক পর্যায় থেকে সম্প্রচার—সর্বত্রই পরিবর্তন দেখা যায়। ব্যতিক্রম ঘটেনি এবারও। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিটিভির কার্যক্রম বদলে গেছে জাদুকরী কায়দায়! ৫ আগস্টের আগেও চ্যানেলটিতে প্রচারিত সংবাদ, অনুষ্ঠান ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহতের মাস আগস্ট উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে, আবার পর্দার এক কোণে ছিল শোকাবহ আগস্টের লোগো।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর একলহমায় সেসব উধাও!
বিটিভির এই আকস্মিক বদলে যাওয়া দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না এ যুগের অনেক তরুণের। কারণ প্রায় ১৬ বছর এক ধারায়ই চলেছে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমটি। দলীয়করণ কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের কুক্ষিগত করে রাখার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি চান চ্যানেলটিকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রজন্মের উপযোগী করে তুলতে। ১৮ আগস্ট এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘বিটিভিকে দেখলে মনে হয়, আশি-নব্বইয়ের দশকের চ্যানেল। একে তো চ্যানেলটিকে দলীয়করণ করা হয়েছে, আবার অনুষ্ঠানগুলোও এই প্রজন্মের জন্য উপযোগী নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন করা উচিত। শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশে কিছু লোক পদ দখল করে বসবে, এ রকম যাতে না হয়। সত্যিকার অর্থেই যেন প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে।’
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কথায় জ্বলে উঠেছে আশার প্রদীপ। যদিও এখনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দেখা মেলেনি। এমনকি চ্যানেলটি প্রায় এক মাস ধরে অভিভাবকহীন। এর সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৮ আগস্ট। এখন পর্যন্ত নতুন মহাপরিচালক হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ কারণে বিটিভির কার্যক্রম নিয়ে অন্য কর্মকর্তারাও কথা বলতে চাইছেন না। সরকার পরিবর্তনের পর কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, এ প্রসঙ্গে বিটিভি সদর দপ্তরের অনুষ্ঠান নির্বাহী মঈনুর রহমান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি সেভাবে কিছু বলতে পারব না। এই মুহূর্তে বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্বে কেউ নেই। আপাতত ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজারের (নুরুল আজম) সঙ্গে কথা বলতে পারেন। অনুষ্ঠান নীতিমালা কিংবা আনুষঙ্গিক পরিবর্তন নিয়ে তিনি হয়তো বলতে পারবেন।’
বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের জিএম নুরুল আজমকে ফোন করা হলেও তাঁর সাড়া মেলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির অন্য এক কর্মী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, কয়েক দিন আগে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরাও আশা করছেন, শিগগিরই বিটিভির নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ পাবেন। এর আগে আপাতত কেউই চ্যানেলটির গতিবিধি নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিটিভি কিংবা বাংলাদেশ বেতারে গান করতে পারেননি রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা ও আসিফ আকবর। সম্প্রতি তাঁদের দুজনকে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ব্যক্তিগত ঝুটঝামেলা পেরিয়ে শিগগিরই সাড়া দেওয়ার কথা জানালেন কনকচাঁপা। যদিও আসিফ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনো চ্যানেলে আর গান করতে চান না। এই দুই শিল্পীর মতো আরো অনেক শিল্পীই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিলেন ‘কালো তালিকাভুক্ত’ ছিলেন। সেসব শিল্পীর সঙ্গেও এখন বিটিভি থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বিটিভিসংশ্লিষ্ট সংগঠন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন অফিসার্স ক্লাব’-এ এসেছে বড় পরিবর্তন। সংগঠনটিতে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিটিভি প্রাঙ্গণে ক্লাবের সাধারণ সদস্যদের উপস্থিতিতে এই কমিটি গঠিত হয়। নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন নুরুল আজম পবন এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান কাজল।
সম্প্রতি বিটিভিতে প্রচারিত উল্লেখযোগ্য কিছু অনুষ্ঠানের কথা না বললেই নয়। যেমন—এ প্রজন্মকে নিয়ে প্রচারিত হয়েছে ‘তারুণ্যের অহংকার জেন-জি প্রজন্মের আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদন। এটি ছাড়াও বদলে যাওয়া বিটিভির সাক্ষ্য দেয় বেশ কিছু প্রতিবেদন ও অনুষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে বহুল চর্চিত ‘আয়নাঘর’-এর ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবেদন, ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘নিপীড়নের গল্প’, আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়মের ওপর ‘ফ্যাসিবাদের দিনলিপি’। এ ছাড়া ‘আগামীর বাংলাদেশ’-এর মতো নানা আলোচনা অনুষ্ঠান এবং এর অতিথি তালিকা দেখলেই পরিবর্তনটা দৃশ্যমান হয়।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন