‘গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
‘কাঠবেরালী! কাঠবেরালী! পেয়ারা তুমি খাও?’ ‘ভোর হল/দোর খোলো/খুকুমনি ওঠরে!’-পংক্তিমালার স্রষ্টার জন্মদিনে তাঁরে কী দিব উপহার! তোমার কবিতার সাথে প্রেম থাকুক আমার, এ কামনাই বারবার । সেই ছোট্ট বেলায় ‘প্রভাতী’ এবং খুকী ও কাঠবেরালী কবিতা দিয়ে পরিচয় হয়েছিলে বাংলার শ্রেষ্ঠ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে । বয়স বৃদ্ধির তালে তালে খুব মিশিয়াছি বিদ্রোহী, সাম্য ও প্রেমের কবি নজরুল প্রতিভার সাথে । কবির প্রত্যেকটা লেখা পড়লেই মন হয়ে আজও যেন কবির সাথে কথা বলছি নিরবে-নিভৃতে ।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস ও ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’ প্রবন্ধ পড়তে পড়তে কবির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি বারবার । একজন লেখক বাস্তবতাকে কল্পনার তুলিতে এমন জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলতে পারে-তা বুঝি নজরুল না পড়লে অজানাই থেকে যেত । প্রিয় ও জাতীয় কবির লেখা প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, বিজয়িনী, সাম্যবাদী, মানুষ, বারাঙ্গনা, নারী, কুলি-মজুর, খালেদ প্রভৃতি কবিতা পাঠ করে প্রতিটি রক্ত কণিকা নতুন করে শিহরিত হয়েছে, পেয়েছে তারুণ্যের দীপ্ত শক্তি ও শপথ । জেগে উঠেছে বিবেক । প্রতিবাদ জন্মেছে দুর্বল চিত্তেও । এই তো কবির ধর্ম, যিনি ‘যৌবনের-জল-তরঙ্গের’ মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের/মানুষের করণীয় কী ।
কবির জীবনজুড়েই ছিল দারিদ্র্যের চরম কষাঘাত । তাইতো তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন ‘দারিদ্র্য’ কিংবা ‘দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়’ নামক বিখ্যাত কবিতাদ্বয় । প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্প শিক্ষিত কবি এমন সব শিক্ষার আলো মানুষের কাছে তুলে দিয়েছেন, যাতে তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবনত মনোযোগ থাকবে কালান্তর ব্যাপীয়া । এই তো কবি, আমাদের কবি, প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহেরও কবি, সাম্যের কবি, প্রিয় কবি কাজী নজরুল । সাদামাটা জীবনে একখানি প্রেমের ফালিতে ডুবেছিলেন সারাটা জীবন । মধ্যযৌবনে বাকশক্তি হারিয়েও মনের শাক্তি হারাননি মোটে ।
বটিশদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমনের’ মত কবিতা লিখে তিনি শাসকগোষ্ঠীর অগ্নিদৃষ্টিতে পড়েছেন বহুবার । জেলের বদ্ধ কুঠরি, কিংবা শোষকদের অনলদৃষ্টিও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি । তিনি ফিরে এসেছেন বারবার, সাথে নিয়ে এসেছেন নতুন আলো, পুঁঞ্জিবুঁত দ্রোহ । নজরুল গীতি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে সহস্রকাল ধরে । তার রচিত ‘কে বিদেশী বন-উদাসী’, ‘মুসাফির!মোছ্ আঁখি-জল’, ‘কে ডাকিলে আমারে আঁখি তুলে’, ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়’, ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম’, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘আমার দেশের মাটি’সহ সহস্র গীত রচনা করে বাংলার গীত সাহিত্যকে দিয়েছেন উর্বরতা, পরিপূর্ণতা ।
তাঁর সৃষ্টিতে বহুভাষার ব্যবহার তার অনবদ্য পান্ডিত্য ও অলৌকিক প্রতিভার পরিচায়ক । বাংলার সাথে ফার্সি, হিন্দি, আরবী, উর্দু ভাষার মিলনে তিনি তার রচনাগুলোকে দিয়েছেন অনবদ্য প্রকাশভঙ্গী । পাঠকের সাথে কবির সৃষ্টিসমগ্রে প্রেম হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার পড়ে না । এ আমাদের কবি, এ মাটির কবি, এ আলোর কবি, আমাদের নজরুল । কবিতা, গান, ছোটগল্প, উন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ-অনুসৃতি, শিশু-কিশোরতোষ কবিতা, অভিভাষণ ও চিঠিপত্রে আজও নজরুল আমাদের মাঝে উপস্থিত স্ব-ভাস্বরে । তার সৃষ্টির স্বতন্ত্র আবেদন ফুরাবেনা কোনদিন, কোনকালে । ভালোবাসি নজরুলকে এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করি নজরুল প্রতিভার ।
‘গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’,‘গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’,‘হিন্দু না ওরা মুসলিম-ওহে জিজ্ঞাসে কোন জন ? কান্ডারী ! বলো ডুবিছে মানুষ/সন্তান মোর মা’র।’-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নবযুগের স্রষ্টা নজরুল স্বীকৃতি আজ চরমভাবে উপেক্ষিত । তার সৃষ্টিকে পাঠক থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দূরে রাখা হয়েছে। এটা কেন হচ্ছে, কাদের স্বার্থে হচ্ছে-সে প্রশ্ন খুব অমীমাংসিত । তবুও ভালোবাসি নজরুলকে । সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে আজও বারবার নজরুলকেই খুঁজে ফিরি । প্রকটভাবে ভালোবাসি তার সমগ্রকে । তোমার জন্মদিনে শুধু নয় বরং সর্বক্ষণে নজরুল মিশে থাকে আমাদের রক্তে, আমাদের নিঃশ্বাসে । ভালো থেকো কবি । প্রার্থণা করো, তোমাকে অনুসরণ করে মোরাও যেন আলোর পথে চলতে পারি ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন