ফারহানা হেনাঃ ধর্ষণ নিয়ে চারদিকে রীতিমতো ত্রাহী ত্রাহী রব উঠেছে। পত্রিকার পাতা, অনলাইন গণমাধ্যম ও সম্প্রচার মাধ্যমের সংবাদে একদল হিংস্র শ্বাপদের থাবা দেয়ার খবর। দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। অনেক স্থানে পৈচাশিকভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে ধর্ষিতাকে। ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যাচ্ছেনা শিশুরাও। আঁতকে উঠার মতো তথ্য দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। সংস্থাটির এক রিপোর্ট বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রতিঘণ্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হয়।
পত্র পত্রিকার বরাতে বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যাণ গুলোতে নজর দিলেই বিষয়টুকু স্পষ্ট হয়। ‘একটি জাতীয় দৈনিকে জাতীয় মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সমীক্ষা দেখে রীতিমতো প্রাণ আৎকে ওঠে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৪ জন নারী, এদের মধ্যে ৩০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে,গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬ জন। ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ১০৭ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে এবং গণধর্ষণ হয়েছেন ৩৫ জন। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৬ জন। ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৭ জন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০০ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৬ জন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ১১৫, ২০১৫-তে ১৪১, ২০১৬-তে ১৫৮ এবং ২০১৭তে ২উঅ শতাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী ধর্ষণের ঘটনা কোনো বছর তুলনামূলক কম-বেশি হলেও গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও ধাপে ধাপে প্রতিকূলতার জালে জড়িয়ে পড়ছে বিচার প্রাপ্তির আশা।
এছাড়াও গ্রাম্য সালিশের নামে এক প্রহসণ তো আছেই। সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছে ধর্ষিতার পরিবার। অনেকটাই মৌখিকভাব একঘরে রাখা হচ্ছে ভিকটিমদের।
এছাড়াও বর্তমানে যুক্ত হয়েছে নতুন সমস্যা। নারীদের পোষাকের দোহাই দিয়ে ধর্ষণ জায়েজ করার চেষ্টা করছে একদল অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষ। এর ফলে একটি বিশাল ধর্মন্ধ শ্রেণী তৈরি হচ্ছে। অনেক ধর্মগুরু প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িকতা ও নারী প্রতি সহিংসতা উষ্কে দিচ্ছে। এসব অর্ধশিক্ষিত লোকেরা স্বল্পমূল্যে স্মার্টফোন কিনেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে নারীবিদ্বেষীতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। মজার বিষয় হলো আমাদের দেশের কথিত অর্ধশিক্ষিত শ্রেণী সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের জন্য নারীর পর্দা না করাকে দোষারোপ করায় যতটা তৎপর তার বিন্দুমাত্র্রও দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিপক্ষে একদমই নয়। দেশে মাদকের সহজলভ্যতার ফলে ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ছড়ানো হচ্ছে উষ্কানী ও নারী বিদ্বেষীতা।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের উপস্থিতি ব্যপকহারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারীদের সহজাত বিষয়গুলোকে দেখানো হচ্ছে ট্যাবু ও নোংরা হিসেবে। যান্ত্রিকতা, আধুনিকতা ও অতিরিক্তে পড়ালেখার চাপের ফলে পারিবারিক সুশিক্ষা ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যে চর্চাটুকু পরিবার থেকে আসা উচিত ছিলো তা আর আসছে না। সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদন মাধ্যম গুলোতে সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নারীকে ভোগ্যপণ্য বানানো হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে অর্থের বিনিময়ে যৌনতা কেনা যায়। এসবের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করার নয়। আমরা প্রতিনিয়তই এসবের শিকার হচ্ছি। বিকৃত মানসিকতার বিষবাষ্পে চারিদিক ভারী হয়ে আসছে। সবই যেন গা সহা হয়ে গেছে। ধর্ষণ হয়েছে একদল প্রতিবাদ করছে, একদল নারী বিদ্বেষীতা ছড়াচ্ছে, আরেকদল যেমনটা ধর্ষণ করার তেমনটাই করে যাচ্ছে। কিছু কাপুরুষ দলবেঁধে ধর্ষণের জন্য নারীর পোষাককেই দায়ী। এই তথইবচ অবস্থায় ঘটছে এসব অমানবিক অপরাধ। আমরা যেন শুধুই নির্বাক দর্শক। আমাদের কিছু করার নেই, কিছু বলার নেই, যেন নির্বাক চেয়ে থাকা।
এদিকে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তিনটি ধাপে ধর্ষণের মামলা দুর্বল করে দেওয়া হয় বলেই ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না বিচারপ্রার্থীরা। আইনজীবী, ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, থানা, শারীরিক পরীক্ষা ও সাক্ষী উধাও- এই তিন ধাপের গড়মিলের মধ্যদিয়ে ধর্ষণ মামলা দুর্বল করা হয়। সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে সাক্ষীদের পিছিয়ে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। মূলত এসব কারণে ধর্ষণের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশে এক হাজারে মাত্র চারজন আসামি ধর্ষণ মামলায় সাজা পায়৷
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, তারা এই পুরো প্রক্রিয়ার একটি অংশ মাত্র। পুরো দায় কোনোভাবেই পুলিশের নয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঁচ হাজার তিনটি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ ভাগ।
পুলিশ সদর দফতরের নথি অনুয়ায়ী, দেশে মোট ৪৩ হাজার ৭০৬টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার মামলায় এক লাখ আসামি খালাস পেয়েছে। আর ধর্ষণ মামলায় খালাস পেয়েছে ৮৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ আসামি। নারী নির্যাতনের মামলায় আসামি খালাসের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ।
অনেক সময় আলোচিত ঘটনায় আসামি খালাস পেলে প্রশ্ন ওঠে, কী কারণে তারা খালাস পেল। অন্য ক্ষেত্রে আসামি খালাসের ঘটনা অগোচরেই থেকে যায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি বিচার প্রক্রিয়া মূলত সুঁই-সুতা দিয়ে বুননের মতো। একটু একটু করে সেটি যৌক্তিক পরিণতি পায়। যেকোনও একটা জায়গায় ছেদ পড়লে সেটি সঠিক পরিচালিত হবে না। প্রাথমিকভাবে তিনটি স্তর দেখা যায়, যেখানে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
অনেকে বলছেন, অপরাধী হওয়ার পরও আসামিদের সাজা না হওয়ার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে মূলত তিনটি কারণে। তদন্ত পর্যায়ে পুলিশের দুর্বলতা, আর্থিক লাভ ও প্রভাবশালীদের চাপ এবং সাক্ষীদের মোটিভেশনের অভাব– এই বিষয়গুলো এর পেছনের কারণ হি

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন