বাংলাদেশে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কৌশল প্রত্যাশা

gbn

দে লো য়া র  জা হি দ

জীবনের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনিয় পানি সম্পদ হল মানুষের জন্য দরকারী বা সম্ভাব্যভাবে উপযোগী। পানির অনেক ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালি, কৃষি, শিল্প, বিনোদনমূলক এবং পরিবেশগত কার্যক্রম। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ সমস্ত মানুষের ব্যবহারের জন্যই  প্রয়োজন বিশুদ্ধ পানি বা  জল । জল সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের উপর এর প্রভাব নিয়ে মানবজাতির উদ্বেগের শেষ নেই. সহজ ভাষায় বলতে গেলে  জল সম্পদ ব্যবস্থাপনার  বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত জরুরি বিষয় যেমন ভবিষ্যতের জন্য জলাশয়ের উন্নয়ন, উপলব্ধ জলাশয়গুলিকে দূষণ ও অতিরিক্ত শোষণ থেকে রক্ষা করা এবং বিরোধ প্রতিরোধ করা। এক্ষেত্রে  প্রধান সমস্যা হল জল - এর প্রাপ্যতা, গুণমান এবং ব্যবস্থাপনাকে  নিশ্চিত করা । পরিবেশে উদীয়মান দূষণকারী জল সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ।  


বাংলাদেশের সমস্ত ধরণের ভূ-পৃষ্ঠের জল এবং ভূগর্ভস্থ জলের উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা এবং এ সম্পদগুলির একটি দক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ প্রণীত হয়েছে। জাতীয় পানি নীতির লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের পানি খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্দেশনা প্রদান, এবং সমাজের সমস্ত উপাদান, বিশেষ করে দরিদ্র, মহিলা এবং শিশুদের জন্য জলের প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করা।  সরকারী এবং বেসরকারী জল সরবরাহ ব্যবস্থার বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে নীতিটি যথাযথ আইনি ও আর্থিক ব্যবস্থা এবং  প্রণোদনা সহ পানি বিকেন্দ্রীকৃত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনার এবং একটি আইনি ও নিয়ন্ত্রক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য দায়িত্বশীল, এছাড়াও জল সরবরাহ ব্যবস্থার বিকাশ পানি প্রাপ্যতার  অধিকার এবং পানির মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব রয়েছে।

 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।  তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছি। পানি সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্যে আমাদেরকে প্রকৃতি ভিত্তিক কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।’

আজ বিশ্ব পানি দিবস-২০২২ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি জলাধার নির্মাণ এই দু’টি বিষয় মনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দেন।  
বাসস জানায় প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ৪ এপ্রিল, নগরীর গ্রিন রোডের পানি ভবনের মূল ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে শেখ  হাসিনা বলেন, আমাদেরকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভে জলাধার নির্মাণের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলকে খাল, বিল, হাওর ও বাওড়ের সাথে নদীর সংযোগবিন্দু সমূহ খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন তা না হলে নদীর নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বরোপ করেন।
 শেখ হাসিনা নদী খননের সময় নাব্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি কিংবা বন্যার পানি সংরক্ষণে বাফার জোন তৈরির ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেন, এই পানি শীতকালে চাষাবাসে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বন্যার সঙ্গে কিভাবে বাঁচতে হয়, সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রধানমন্ত্রী সড়ক কিংবা বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নেয়ার সময়ে গাছের চারা লাগানোরও নির্দেশ দেন কারণ এ পদক্ষেপ ভূমিধস থেকে রক্ষায় সহায়ক হবে। তিনি সকলকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোরও নির্দেশ দেন। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

পৃথিবী সত্যিই জলের গ্রহ। তারপর ও দেশে দেশে জলের ঘাটতি বা জল নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে যার মধ্যে জল সম্পদের সরবরাহ এবং চাহিদার সাথে বিতরণ ব্যবস্থা অত্যন্ত অসম। বিশ্বে পানি সম্পদ প্রচুর হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সুস্বাদু পানির সীমাবদ্ধতা, পানির সম্পদের অনিয়মিত বন্টন, মানুষের অনুপযুক্ত শোষণ ও ব্যবহার দূষণের কারনে পানি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি সম্পদ এলাকা, পানি সংরক্ষণের অসচেতনতা ছাড়াও  বর্জ্য পানির ঘটনা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে । জল সম্পদের অভাব আছে এমন এলাকায় সমস্যা সমাধানের জন্য জল সম্পদের ব্যাপক শোষণ এর ফলে ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জল দূষণ হয়ে জল চক্রকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এতে মোট সুস্বাদু জলের সম্পদ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে । মহাসাগরগুলো ভূপৃষ্ঠের ৭২% জুড়ে, জলের গোলক আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার ধারণ করে। তবে এর ৯৭.৩ % লোনা জল। লবণ এবং অন্যান্য কারণে, লবণাক্ত পানি পান, সেচ এমনকি শিল্পের জন্য তা উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশে জল ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা বোঝার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা জলখাতের বিশেষজ্ঞদের অবশ্যই চিন্তার খোরাক যোগাবে।

বার্তা সংস্থা বাসস আরো জানায়, শেখ হাসিনা নদীগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা বজায় রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি বা বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য বাফার জোন তৈরির পরামর্শ দেন, যাতে করে ওই পানি শীতকালে চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জানতে হবে কিভাবে বন্যার সঙ্গে বাঁচতে হয় এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় (যেহেতু বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ)।

 
প্রধানমন্ত্রী রাস্তা বা বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণের সময় গাছ লাগানোরও নির্দেশ দেন কারণ এগুলো ভূমিধস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। তিনি সকলকে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমানোর নির্দেশ দেন কারণ বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সেচ কাজে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে জনগণকে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে, তিনি দেশবাসীকে গৃহস্থালি, নির্মাণ বা সেচের মতো যেকোনো কাজে পানি ব্যবহারে সংযমী হওয়ার অনুরোধ করেন কারণ, পানি পরিশোধনে সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিতে কোনো অবদান না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মতো কিছু ক্ষুদ্র দ্বীপ ও দেশকে এর প্রভাবের খেসারত বহন করতে হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, “সুতরাং, দেশকে বাঁচাতে আমাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে। "  প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা  দেওয়ায় ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নিরাপদ ও উন্নত জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা ডেল্টা প্ল্য্যান-২১০০ প্রণয়ন করেছেন এবং তা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।  শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানীয় জল নিশ্চিত করে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-৬ বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সফলভাবে ৯৭ শতাংশ মানুষের জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করেছি এবং আমরা সকলের জন্য নিরাপদ পানীয় জল নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে সারা বিশ্বে যথাক্রমে ৩.৬ বিলিয়ন এবং ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের বিপুল পানিসম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিপুল পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশবাসী কখনোই নিরাপদ খাবার পানির সংকটে পড়বে না। বরং বিশ্বে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারব।’


প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং ‘ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন।  শেখ হাসিনা বলেন, ফলোআপ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের জন্য জাতীয় নীতি-১৯৯৮ প্রণয়ন করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্ব পানি দিবস-২০২২ উপলক্ষে দেয়া বক্তব্য একটি কৌশলগত আলোচনার জন্য আমাদের চিন্তার খোরাক এনে দিতে পারে, সহযোগিতাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে, প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে পারে এবং চিন্তার নতুন ও উদ্ভাবনী উপায়গুলিকে আরো  প্রসস্থ করতে পারে। প্রথম এবং সর্বাগ্রে, শেখ হাসিনার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতিগুলির আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে দেশে একটি ব্যাপক কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। জল-দক্ষতা নীতির সাথে সমন্বয় ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার সহায়তায় জাতীয় কৌশল প্রণয়নের অধীর অপেক্ষায় দেশবাসী।


লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অফ ম্যানিটোবা, সাবেক বোর্ড অব ডিরেক্টরস মেম্বার প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন