জুলাই ঘোষণা এক বিকৃত রচনা

gbn

সিরাজী এম আর মোস্তাক ||

২০২৫ সালের ৫ আগষ্ট বৃষ্টিভেজা বিকেলে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সামনে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড, ইউনুস মহোদয় ২৮ দফার একটি জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। যেহেতু সেহেতু দিয়ে রচিত ঘোষণাপত্রটির প্রথম দফাতেই মারাত্মক ভুল বা বিকৃতি পরিলক্ষিত হয়েছে। মোটাদাগে বিবেচনা করলে প্রায় প্রতিটি দফাতেই কিছু না কিছু ভ্রান্তি রয়েছে, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো সম্ভব। এখানে বিশেষ কিছু বিকৃতি তুলে ধরছি, যাতে পাঠক সমাজ বাকী ভুলগুলো তারা নিজেরাই উদঘাটন করেন। প্রথম দফাতে উল্লেখযোগ্য যে ভুল বা বিকৃতি হয়েছে তাহলো, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে উল্লেখ হয়েছে যে, মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বিকেলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে বন্দী হবার আগ পর্যন্ত শত অনুরোধ সত্তে¡ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি মর্মে তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। প্রথম দফাতে আরো অধিক ভ্রান্তি রয়েছে। তাহলো, পাকিস্তানের ২৩ বছর স্বৈরশাসকদের বঞ্চণা ও শোষণের বিরূদ্ধে রুখে দাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসনামলে এদেশে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো দুর্ভিক্ষ বা দুর্ঘটনার ইতিহাস নেই, যার জন্য মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এ দফাতে উপনিবেশবাদের বিরূদ্ধে আন্দোলন বলতে শুধু ২৩ বছরের সংগ্রামকেই সীমাবদ্ধ করেছেন, যাতে সুদীর্ঘকালের বৃটিশবিরোধী, ভারতের প্রতিহিংসা ও শেরে বাংলাসহ অসংখ্য পুর্বসূরীদের জীবনপণ লড়াইয়ের স্মৃতির বিচ্যুতি বা বিকৃতি ঘটেছে। দ্বিতীয় দফাতে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা বলা হয়েছে, তা রচনা ও ঘোষণা উভয়ই ভারতের মাটিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী সাড়ে সাত কোটি জনতা ও ৩০ লাখ শহীদ সবাই শুধুমাত্র স্বাধীনতার জন্যই লড়াই করেছে ও জীবন দিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিশেষ চিন্তা কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদের মধ্যে তখনো ছিলনা। ৩য় দফাতে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সাথে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ৪র্থ দফাতেও আওয়ামীলীগের ব্যর্থতা ও জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ৩য় ও ৪র্থ দফাতে জুলাই বিপ্লবের মূল স্পিরিট বিকৃত হয়েছে। মূলত জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বৈষম্যমূলক তালিকা ও খেতাবের বিরূদ্ধে। যে যুদ্ধে দেশের আপামর জনতা ভুমিকা পালন করেছে ও প্রাণ হারিয়েছে, অথচ ভারত প্রদত্ত কতিপয় বিশেষ তালিকার কারণে পুরো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৈষম্য ও বিকৃত করা হয়েছে। ৫ম-১০ম ধারাতে রাজনৈতিক ঘটনাক্রম উল্লেখ হয়েছে। তাতে বিশেষভাবে আওয়ামী সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। ১১-১৩ ধারায় শুধুমাত্র আওয়ামী শাসনের সমালোচনা করা হয়েছে। ১৪-১৮ ধারায় জুলাই আন্দোলনের পর্যায়ক্রম বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু যে বিশেষ শ্লোগানে জুলাই আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছে তা গোপন করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলন মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্যের বিরূদ্ধে ২০২৪ এর ৫ই জুন হাইকোর্টের একটি আদেশের কারণে শুরু হয়েছিল। আর তার চুড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে ১৪ জুলাই মধ্য রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নির্ভীক ছাত্রছাত্রীদের দুর্বার শ্লোগান- তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার এর মাধ্যমে। ১৯-২৮ ধারায় সরকার গঠন, তাদের কর্মকান্ডের ফিরিস্তি এবং অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। উল্লেখিত ক্রম বিশ্লেষণে সুস্পষ্ট হয় যে, জুলাই ঘোষণার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যথাযথ পুরণ হয়নি। বরং এর মূলধারাগুলো বিকৃত হয়েছে। যে কোনো ঘোষণাপত্র সারসংক্ষেপ ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া বান্থনীয়, যা জুলাই ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত। জুলাই ঘোষণাপত্রে মূলত জুলাই আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা উল্লেখই যথেষ্ট ছিল। এটি সম্পুর্ণ বিকৃতি ঘটেছে। অতএব সংক্ষেপে বলতে গেলে, জুলাই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫জুন ২০২৪ তারিখে ১৯৭১ এর বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরূদ্ধে হাইকোর্টের একটি আদেশের ফলে। এ আন্দোলনের চুড়ান্ত বিকাশ ঘটে ১৪জুলাই একটি শ্লোগানের মাধ্যমে যা সরাসরি ১৯৭১ এর স্বাধীনতার ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কচিমনে প্রশ্ন জাগে, ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের স্বাক্ষরতা অনুষ্ঠানে ভারতের একক আধিপত্য অথচ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও কোটা বৈষম্য বিষয়ে মারাত্মক অপপ্রয়োগ নিয়ে। আপামর জনতার সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হয়, ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে দেশীয় কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের নারকীয় হত্যাকান্ডের দৃশ্য সত্তে¡ও বীরউত্তম খেতাবের রহস্যের কারণে। একইসাথে নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের খেতাব বঞ্চণা এবং ভারতে গুম ও আটকের ঘটনা বিগত আওয়ামী শাসনে সুখরঞ্জন বালিসহ অসংখ্য গুম, খূন ও আয়নাঘরে নির্যাতনের হুবহু মিলানো বর্ণনায়। জুলাই আন্দোলন একক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির নয়। এটি উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে পুরো জাতির জাগরণ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল। যাতে মিশে আছে অসংখ্য প্রাণ ও আত্মত্যাগের মহান বিসর্জন। সুতরাং জুলাই আন্দোলনের প্রত্যাশা হলো, ১৯৭১ এর তথাকথিত বৈষম্য, বিভাজন ও বিশেষ সুবিধা চিরতরে বাতিল করা। ৭১ কে আবারো স্বার্থের বশে ব্যবহারের পথ চিরতরে বন্ধ করা। ১৯৭১ এর নামে বৈষম্যের সুবিধাভোগীদের বিষয়ে ক্রমান্বয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একইভাবে ২০২৪ এর জুলাই নিয়ে তদ্রæপ বৈষম্য বা বিশেষ সুবিধাজনক ব্যবহার বন্ধ করা। সুস্পষ্ট প্রমাণের ক্ষেত্রে বিচার কার্য্যক্রম চালানো ও জন আকাঙখার রাষ্ট্র গঠণে যথাযথ সংস্কারসহ স্থায়ী পদক্ষেপের সাংবিধানিক সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন