যুক্তরাষ্ট্রের সেকেন্ডারি শুল্ক আরোপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি চীনা পণ্যের ওপর সেকেন্ডারি শুল্ক আরোপ করেন তাহলে তা বাস্তবায়ন করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে যে পরিমাণে পণ্য আমদানি করে তা ভারতের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। এই পণ্যের বেশিরভাগই ভোক্তা পণ্য যেমন খেলনা, পোশাক ও ইলেকট্রনিক্স।
বেইজিংকে লক্ষ্য করে সেকেন্ডারি শুল্ক আরোপ করলে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য পুনর্বিবেচনার যে আলোচনা ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের পর থেকে করে আসছেন, তাও ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
আইএমডি বিজনেজ স্কুলের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাইমন ইভেনেট বলেন, এ ধরনের অতিরিক্ত চাপ চীনাদের ওপর প্রভব ফেলার সম্ভাবনা কম। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, চীনকে রাশিয়ার দিক থেকে সরানো খুব কঠিন হবে যদি না কোনো জোরালো কারণ থাকে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং পুতিন একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
এছাড়া ট্রাম্প যখন আগে চীনের ওপর তিন অঙ্কের শুল্ক আরোপ করেছিলেন তখন এটা কাজ করেনি। দুই দেশের মধ্যে প্রায় সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ রকম উদ্যোগ আরও একবার নিলে তা যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়াতে পারে যেটা বহুদিন ধরে মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ট্রাম্প।
চীনের অর্থনীতি এরই মধ্যে নানা সংকটে ভুগছে এবং এ ধরনের পদক্ষেপে চীনে উৎপাদন খাতে বিপুল সংখ্যক চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাণিজ্য আরও ক্ষতির মুখে
ফিনল্যান্ডভিত্তিক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্ক এখনো রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি ক্রেতা। ২০২২ সালের আগে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় রপ্তানির গন্তব্যস্থল ছিল ইইউ, যদিও ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে সেই পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
ব্রাসেলস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে জ্বালানি কেনার চুক্তি করেছে। কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে কিছু আমদানি এখনো বহাল আছে। জুনে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন এ সমস্যাকে স্বীকার করে বলেছেন, জ্বালানি সরবরাহকে অস্ত্র বানিয়ে রাশিয়া বারবার আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে।
২০২৭ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে সব ধরনের জ্বালানি আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর বাণিজ্য সম্পর্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড়। সম্প্রতি এই পক্ষ এক নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে যার আওতায় ইইউ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে।
ইইউর অনেক সদস্য দেশ এই চুক্তির সমালোচনা করে বলেছেন, এই শুল্ক ইউরোপিয়ান রপ্তানিকারকদের ক্ষতি করবে। সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা ইইউর জন্য আরও বড় হুমকি হতে পারে বলে এখন তারা আশঙ্কা করছে।
যদি রাশিয়ার জ্বালানি কেনার কারণে শতভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে ইইউ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া পণ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে। তবে রাশিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও মেশিনারির মতো বড় রপ্তানি খাতগুলো অন্য কোনো দেশ থেকে পাওয়া খুব কঠিন। অর্থাৎ আমেরিকানদের জন্য বেশি টাকা দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।
সম্ভাব্য মন্দার দিকে রাশিয়া
ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পরও রাশিয়ার নিজের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল রয়েছে। গত বছর প্রবৃদ্ধি ছিল চার দশমিক তিন শতাংশ। তবে সম্প্রতি দেশটির ইকোনমি মিনিস্টার ম্যাক্সিম রিশিতনিকভ সতর্ক করে বলেছেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে দেশটি মন্দার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে, এ বছর রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। যদি সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা রপ্তানির চাহিদা কমাতে সক্ষম হয় তাহলে রাশিয়া মন্দার আরও কাছাকাছি পৌঁছাবে।
রাশিয়ার অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব ঠিক কেমন হবে তা জানা খুব কঠিন। কারণ পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে মস্কো তাদের অনেক অর্থনৈতিক তথ্য, যেমন- তেল এবং গ্যাস উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
রাশিয়া সরকারের ব্যয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশই আসে তেল এবং গ্যাসের আয় থেকে, কিন্তু রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে কোল্ড ওয়ার (স্নায়ুযুদ্ধ) পরবর্তী সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ছয় দশমিক তিন শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। বিপরীতে ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির ২৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করছে। এই পার্থক্যই বোঝায় কেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার তার মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা চেয়ে আসছেন।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ট্যারিফ বা শুল্কের উদ্দেশ্য হলো রাশিয়ায় অর্থের প্রবাহ কমিয়ে দিয়ে জেলেনস্কিকে সাহায্য করা। এর মাধ্যমে ইউক্রেনে মৃত্যু, দুর্ভোগ ও ধ্বংসের অবসান ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছেন ট্রাম্প।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন