ঝালকাঠির নাথুল্লাবাদ ইউনিয়নের চাচইর গ্রামের সাধারণ এক ঘরেই জন্ম ও শৈশব কাটিয়েছেন সৈয়দ মাহিন। বাবা সৈয়দ ইলিয়াস শিক্ষক, মা কানিজ ফাতেমা আকতার গৃহিণী। সংসারের অভাব-অভিযোগের মধ্যেও বাবা ছেলেকে দেখিয়েছেন আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন। বেড়ে ওঠা ঢাকার বাড্ডায়।
আলাতুন্নেসা স্কুল থেকে এসএসসি, এরপর ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি শেষে বাবার সেই বহুদিনের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভর্তি হন ঢাকার বেসরকারি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে।
কিন্তু মাহিনের পথচলা কেবল বাবার স্বপ্নপূরণেই থেমে থাকেনি। নিজেরও ছিল অকল্পনীয় কিছু স্বপ্ন যা হয়তো একসময় কেবল কাগজের পাতায় বা মনের ভেতরে ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই সুযোগ আসে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বমঞ্চে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাঁড়িয়ে বিজয়ের পতাকা হাতে উল্লাস করেছেন মাহিন। বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেছেন গর্বভরে।
একজন শিক্ষক বাবার স্বপ্ন, ছেলের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর নিরলস পরিশ্রম সব মিলে জন্ম দিয়েছে এই অর্জনের গল্প।
আজ ঝালকাঠির সেই ছোট্ট ছেলেটি কেবল পরিবারের নয়, পুরো দেশের গর্ব। মাহিন প্রমাণ করেছেন স্বপ্ন যদি হয় দৃঢ় আর পথচলায় থাকে অধ্যবসায়, তবে গ্রামের সাধারণ ঘর থেকেও বিশ্বমঞ্চ জয় করা সম্ভব।
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহর। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আদলে গঠিত কোর্টরুমে বিশ্বের ৪৫টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা, যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন শেখার একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম।
বাস্তব আইসিসির বিচারপ্রক্রিয়ার মতো অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, মানবাধিকার ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাওয়া যায়। সেই কোর্টরুমে দাঁড়িয়ে একজন তরুণ বলছেন, ‘ইওর অনার, অন বিহাফ অব দ্য ভিকটিম...।’ এই কণ্ঠ বাংলাদেশের, এই আত্মবিশ্বাস প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির।
এ বছর নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে গত ১১ থেকে ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হয় ২০২৫ সালের আইসিসি মুট কোর্ট কম্পিটিশন। আয়োজক লেইডেন ইউনিভার্সিটি। এতে অংশ নেন বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধিত্ব করে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। আর সেখানেই অভাবনীয় অর্জন বিশ্বের ৪৫টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘স্পিরিট অব দ্য কম্পিটিশন’ পুরস্কার জিতেছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশের জন্য এটি প্রথম। সেই অর্জনের অন্যতম সদস্য মাহিন।
মাহিন বলেন, ‘এটি আমার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, প্রথম বিদেশ সফর, এমনকি প্রথম বিমানযাত্রা। প্রতিযোগিতার আগের রাতে চোখে ঘুম আসেনি। ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছিল এই দেশ, এই পতাকা সব যেন আমাদের কাঁধে। প্লেনের জানালায় তাকিয়ে ভাবছিলাম, বাবা কি গর্ব করছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি আনন্দোল্লাসের অপেক্ষায়?’
তিনি বলেন, প্রতিযোগিতার আগে এক মাসের বেশি সময় ধরে রাত-দিন পরিশ্রম গেছে। দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন আরো চারজন মো. মাহবুবুর রহমান সোহাগ, সোনালী রাজবংশী ও দীপান্বিতা চাকমা।
প্রশিক্ষণ দিয়েছেন প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের প্রভাষক সালসাবিল চৌধুরী ও সহকারী কোচ মো. রাফি ইবনে মাসুদ।
মাহিন আরো জানান, এই প্রতিযোগিতা শুধু মেধার নয়, কৌশল, ধৈর্য, যুক্তি আর সাহসের। প্রসিকিউটর, ভিকটিম কাউন্সেল ও ডিফেন্স এই তিনটি ভিন্ন ভূমিকায় যুক্তি উপস্থাপন করতে হয়। প্রতিটি ভূমিকায় ছিল কঠিন প্রস্তুতি। পুরো বিচারপ্রক্রিয়া চলে আইসিসির স্টাইল আদালতে।
তিনি বলেন, ‘বইয়ের জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেষ্টা ও অধ্যবসায় এবং প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে। গবেষণা, টাইম ম্যানেজমেন্ট, কোর্টরুম প্রেজেন্স ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মাইলফলক। আন্তর্জাতিক আইনের মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সম্মান পাওয়া এটা অর্জন।’
মাহিন এখন নতুন স্বপ্ন দেখেন এই অর্জন যেন থেমে না যায়। ভবিষ্যতে আরো শিক্ষার্থীকে এমন প্রতিযোগী তৈরি করতে চান তিনি।
মাহিন বলেন, ‘আমরা দেখিয়েছি, বাংলাদেশ পারে। আমি চাই, পরের বছর যারা যাবে তারা আরো বড় অর্জন নিয়ে ফিরুক। আমি তাদের পাশে থাকব।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন