কলকাতার কসবায় একটি ল কলেজে এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে তোলপাড় চলছে পশ্চিমবঙ্গে। গত বছর আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী ইন্টার্ন চিকিৎসককে ধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় রাজ্যজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আবার একই ধরনের অভিযোগ সামনে আসায় নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি ফের সামনে এসেছে।
কসবার ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার সকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই কলেজের এক নিরাপত্তারক্ষীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
এই ঘটনার তদন্তে শনিবার স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করেছে পুলিশ।
লিখিত অভিযোগে ওই ছাত্রী জানিয়েছিলেন, প্রথমে তাকে কলেজের ইউনিয়ন রুমে যৌন হেনস্তা করা হয় এবং গার্ড রুমে (নিরাপত্তারক্ষীর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ) নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। কলেজের নিরাপত্তারক্ষী বিষয়টা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত বছর আগস্ট মাসে কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক-শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ঘটনার তদন্তে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আন্দোলন শুরু করেন নিহত চিকিৎসকের সতীর্থরা। পরে সেই আন্দোলনে যোগ দেন অন্যান্য কলেজের জুনিয়র চিকিৎসক এবং নাগরিক সমাজ।
কেন কর্মক্ষেত্র এবং অন্যত্র নারীরা সুরক্ষিত হবেন না, সেই প্রশ্ন তুলে ডাক দেওয়া হয় ‘রাত দখলের কর্মসূচি’। রাস্তায় নামেন লাখো নারী, পুরুষ এমনকি শিশু ও প্রবীণ নাগরিকেরাও বাদ যাননি। কয়েক মাস ধরে চলা সেই প্রতিবাদের আঁচ এড়িয়ে যেতে পারেনি রাজ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও।
ওই প্রতিবাদের অন্যতম মুখ ডা. অনিকেত মাহাত বলেন, আন্দোলনে আমাদের যে কয়টা দাবি-দাওয়া ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত এবং রাজনৈতিক প্রভাবহীন একটা লেখাপড়া ও কাজের পরিসর। সেই সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি জানিয়েছিল সরকার।
‘কিন্তু এক বছর যেতে না যেতে আমাদের আরও একবার সেই একই রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কোথায় নিরাপত্তা? কোথায় রাজনৈতিক ছোঁয়াচ-মুক্ত শিক্ষাক্ষেত্র বা সরকারি হাসপাতাল?’
অন্যদিকে, সবশেষ ঘটনাটিকে ঘিরে রাজনৈতিক ময়দান আবারও সরগরম। বাম, বিজেপিসহ বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেছে। শনিবার কলকাতার একাধিক জায়গায় তাদের প্রতিবাদ মিছিলকে পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কসবার ঘটনায় শুক্রবার যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন বর্তমান ছাত্র। একজন সাবেক শিক্ষার্থী ওই কলেজে অস্থায়ী পদে নিযুক্ত। তৃণমূলের ছাত্র পরিষদের নেতা হিসেবে ওই কলেজে তার (সাবেক ছাত্রের) বেশ প্রভাব রয়েছে বলে জানা গেছে।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ অবশ্য অভিযুক্তর থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে এবং নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবি জানিয়েছে।
আরজি করের পর আবারও শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তার অভাবের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল।
সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, কলেজ ইউনিয়ন তেলবাজি এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে, তার একটাই কারণ হলো এরা রাজনৈতিক মদতপুষ্ট। এখানে যে মূল অভিযুক্ত সে সাবেক ছাত্র, কিছুদিন আগে অস্থায়ী পদে তাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কলেজ ছাড়ার পরেও তার প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় আছে। এর বিরুদ্ধে কিন্তু আগেও একাধিক অভিযোগ উঠেছে, অথচ সে সহজে চাকরি পেয়ে গেল? এটা রাজনৈতিক মদত ছাড়া হতে পারে?
‘আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ-খুনের ঘটনাতেও অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার ছিল। কিন্তু থাকতো পুলিশ ব্যারাকে, ব্যবহার করতো পুলিশের মোটরবাইক, যা বেআইনি। হাসপাতালের ভেতরে তার অবাধ আনাগোনা। কী অদ্ভুত মিল!’
নিরাপত্তা কোথায়?
আরজি করের ঘটনার আন্দোলনে সামিল ছিলেন শতাব্দী দাশ। ‘রাত দখল’ কর্মসূচিতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এই শিক্ষক। তার কথায়, ভাবতেই অবাক লাগে বতমান সময়ে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তার কথা আমাদের আলাদা করে বলতে হবে।
‘আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পর অন্যান্য মেডিকেল কলেজে যে তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে উঠে আসা তথ্য ভয়াবহ। যেমন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসক-শিক্ষার্থীকে একইভাবে চরম হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।’
গত কয়েক বছরে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে বিভিন্ন যৌন হেনস্তার ঘটনার উল্লেখ করেছেন আরেক শিক্ষক সুদেষ্ণা সেন। তিনি বলেছেন, স্কুলে নাবালক-নাবালিকাদের ওপর যৌন হেনস্তার একাধিক ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এই তালিকায় একেবারে ছোট শিশুও আছে। বাবা-মা কি স্কুল-কলেজে পাঠিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না? তাহলে নিরাপত্তা কোথায়?
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপিকা এবং সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ ২০১২ সালের অনুরূপ ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।
‘২০১২ সালে আসানসোলে একটি কলেজে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। সেই মেয়েটিকেও কলেজের ইউনিয়ন রুমে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছিল, হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কসবার ঘটনাও একই। দুটো ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে মাত্র।’
ওই ঘটনাতেও কলেজের ছাত্রের পাশাপাশি নিরাপত্তারক্ষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন নির্যাতিতা। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন বহিরাগত ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল।
অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলেন, এমন হতে থাকলে মেয়েরা কলেজে আসতে ভয় পাবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে ইতস্তত করবে। যেখানে আমাদের দেশে অধিকাংশ বড়সড় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন।
কেন বারবার নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন উঠছে?
কেন বারবার শিক্ষাক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ছে শিক্ষাঙ্গন–– এই প্রশ্নের উত্তরে আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ আসফাকুল্লা নাইয়া বলেন, আসলে অপরাধীদের মনে ভয় নেই। তারা জানে কিছু হবে না, কারণ নেতাদের হাত তাদের মাথায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপিকা একাধিক অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০১৭ সালের পর থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কলেজে নির্বাচন হয়নি। কিন্তু প্রত্যেকটা কলেজে ইউনিয়নের ফান্ড আছে, স্টুডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ, গভর্নিং বডির মেম্বার সব এরাই। এরা নির্বাচিত নন, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করেন। ফলে ইউনিয়ন রুমটা এখন ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যার চূড়ান্ত অপব্যবহার করা হয়।
‘কলেজ কর্তৃপক্ষের বলার ক্ষমতা নেই যে ইউনিয়ন রুমের চাবি আমাদের কাছে থাকবে। অধিকাংশ জায়গায় নিরাপত্তারক্ষীরা অস্থায়ী কর্মী, কোনো না কোনো রাজনৈতিক মদতে কাজ পেয়েছে। তার সুপারিশে হয়ত সে চাকরি পেয়েছে, তাই কলেজ ইউনিয়নের তথাকথিত দাদাদের কথায় সম্মতি জানাতে বাধ্য।’
কসবার ঘটনায় তদন্তের জন্য সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিসিটিভি থাকলেও তা কাজ করে না বা তার ফুটেজের নজরদারি হয় না বলেও অভিযোগ তুলেছেন ওই অধ্যাপিকা।
তার কথায়, সিসিটিভি যদি আদৌ থেকে থাকে তার লাভ কী? কটা কাজ করে, কয়টা সিসিটিভির ফুটেজ দেখা হয় হয়? কোনো ইউনিয়ন রুমে সিসিটিভি লাগাতে দেওয়া হয় না, যদি ভুলক্রমেও তা হয় তাহলে কয়টা ইউনিয়ন রুমের সিসিটিভির ক্যামেরা টেবিল টেনিস বোর্ডের দিকে ঘোরানো থাকে?
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
সাবেক আইপিএস অফিসার এবং বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তার কথায়, এটা সভ্য সমাজের নিদর্শন নাকি? পুলিশ কোথায় তার কাজ করছে? তাদের তো প্রিভেন্টিভ মেজার নেওয়া উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে কি?
‘আগে গোয়েন্দা অফিসাররা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তথ্য জোগাড় করে দেখতেন কোথায় কারা অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত, কারা প্রভাবশালী। এখন সেসব কিছুই হয় না।’
তিনিও অভিযোগ তুলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে যায়। তার কথায়, আসলে কারও মনে ভয় নেই। তারা জানে অমুককে ধরলে ছাড়া পেয়ে যাব। তাই আরজি কর হাসপাতালের মতো ঘটনা ঘটে এবং তার পরে কসবায় গার্ড রুমে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস দেখাতে পারে।
সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা নজরুল ইসলামও সহমত প্রকাশ করেন। তার কথায়, আরজি করের ঘটনায় ধর্ষণ ও খুনের মামলা ছাড়াও দুর্নীতির মামলা চলছে। আসলে কলেজ, হাসপাতাল এই সবগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
এখানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারতী ঘোষ বলেন, নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আগে পুলিশকে নিরপেক্ষ হতে হবে। তার মাথায় যদি ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ থাকে তা সে যে দলই হোক, তাহলে তার কাছ থেকে কীভাবে নিরপেক্ষতা আশা করবেন?
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব?
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, নারীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের সচেষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। তারা মনে করেন নাগরিক আন্দোলনের হাত ধরে বদল আসতে পারে।
ইতোমধ্যে একাধিক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে। সেই তালিকায় আছে ‘রাতদখল নারী-ট্রান্স-ক্যুয়ার ঐকমঞ্চ’-এর পক্ষে একটা প্রতিবাদ সভাও। তার আহ্বায়ক শতাব্দী দাশ বলেন, আমরা কসবার ওই কলেজের কাছে প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছি। অন্যান্য মঞ্চের তরফেও কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজকে সচেতন এবং সমবেত হতে হবে।
ডা. মাহাতও সহমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, কসবার আইন কলেজের ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে বাস্তব চিত্রটা কী এবং আমাদের আন্দোলন কতটা এবং কেন প্রাসঙ্গিক। প্রশাসনকে কিন্তু জবাবদিহি করতে হবে।
নিরপেক্ষ ছাত্র নির্বাচনের পক্ষে সওয়াল করেছেন শাশ্বতী ঘোষ। তার কথায়, ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার স্টুডেন্ট ইলেকশন দরকার। নয়তো ইউনিয়ন রুম ক্ষমতাসম্পন্ন দাদা আর বহিরাগতদের জায়গা হয়ে থাকবে।
পুলিশি নিরপেক্ষতার পাশাপাশি, কড়া আইনি পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন ভারতী ঘোষ। তিনি বলেন, আমাদের এই মামলার দ্রুত তদন্ত ও নিষ্পত্তি করতে হবে। কড়া শাস্তি দিতে হবে যাতে অপরাধীরা ভয় পায়। আর অবশ্যই পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে।
‘তাছাড়া সব শিক্ষাকেন্দ্রে, বিশেষত নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে লালবাজার কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বিপদে তারা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। নারী পুলিশের টিম যাতে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারে তাও নজরে রাখতে হবে।’
পাশাপাশি তিনি বলেন, পুলিশের ভূমিকা তো আছেই। এফআইআর কিন্তু তাদের হাতে। পুলিশ যেভাবে কেস সাজাবে, সেভাবে পরবর্তীকালে সবকিছু হবে। কাজেই যতই রাজনৈতিক চাপ থাক পুলিশের ক্ষমতা কিন্তু আছে। তাদের শুধু সেটা ব্যবহার করতে হবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন