বিষাক্ত মাশরুম এবং ৩ রহস্যময় মৃত্যু, সাবেক পুত্রবধূ অভিযুক্ত

gbn

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত একটি ছোট শহরে ঘটে গেছে এক রহস্যময় বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যু। আলোচিত এ ঘটনার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্ত ৫০ বছর বয়সী এরিন প্যাটারসন, যিনি দুই সন্তানের জননী। আদালতে তিনি তিনটি ‘হত্যাকাণ্ড’ এবং একটি ‘হত্যাচেষ্টার’ মামলায় সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

এরিন বর্তমানে বেশ স্পষ্টভাবেই আদালতের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছেন, যা জনমনে কৌতূহল আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

 

অভিযোগে বলা হয়েছে, এরিন প্যাটারসন তার সাবেক স্বামীর পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি পারিবারিক মধ্যাহ্নভোজে ‘বিফ ওয়েলিংটন’ নামের একটি খাবার রান্না করেছিলেন, যাতে তিনি মারাত্মক বিষাক্ত ‘ডেথ ক্যাপ’ মাশরুম ব্যবহার করেন। এই খাবার খেয়ে তার সাবেক শশুর ডন প্যাটারসন, শাশুড়ী গেইল প্যাটারসন (উভয়ই ৭০ বছর বয়সী), এবং খালা শাশুড়ী হিদার উইলকিনসন (৬৬) প্রাণ হারান। হিদারের স্বামী ৭১ বছর বয়সী ব্যাপটিস্ট যাজক ইয়ান উইলকিনসন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তবে কয়েক সপ্তাহ পর তিনি বেঁচে যান।

 

ড

ছবি: এরিনের সাবেক শাশুড়ী হিদার উইলকিনসন (৬৬) প্রাণ হারান(ডানে)। তবে বেঁচে যান তার স্বামী(ডানে)।

গতকাল দুপুরে এরিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম দিকের প্রশ্নগুলো ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক ও অতীতের মানসিক অবস্থা ঘিরে।

আদালতে তিনি জানান, তিনি এক সময় ‘গোঁড়া নাস্তিক’ ছিলেন, তবে তার স্বামী সাইমন প্যাটারসনের প্রভাবে পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাদের সন্তান জন্মের অভিজ্ঞতাকে তিনি ‘ভীষণ ট্রমাটিক’ বলে অভিহিত করেন এবং জানান, দাম্পত্য জীবনে নানা টানাপোড়েন ছিল। এসব মতানৈক্যের জেরে ২০২৩ সালে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন। এরিন জানান, সেই সময়ে তিনি সাইমনের পরিবারের কাছ থেকে নিজেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন মনে করতেন, এবং ধারণা ছিল তার স্বামী চায় না তিনি তাদের সঙ্গে জড়িত থাকুন।

 

এরিন আদালতে বলেন, সারা জীবনজুড়েই তিনি আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধের ঘাটতিতে ভুগেছেন।

আজকের শুনানিতেও তার এই ব্যক্তিগত দিক নিয়ে প্রশ্নোত্তর চলেছে, যদিও প্রশ্নকারীরা ধীরে ধীরে মামলার মূল বিষয়ে—বিষাক্ত খাবার ও মৃত্যুর পেছনের উদ্দেশ্য—উত্তরণের দিকে এগোচ্ছেন।

 

ঘটনার পটভূমি

২০২৩ সালের জুলাই মাসের এই ঘটনার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেদিনের খাবারের নিমন্ত্রণে এরিনের সাবেক স্বামী সাইমন প্যাটারসনকেও ডাক দেওয়া হলেও তিনি শেষ মুহূর্তে উপস্থিত হননি, ফলে প্রাণে বেঁচে যান। অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে, খাবারে থাকা ‘ডেথ ক্যাপ’ মাশরুমই ছিল মৃত্যুর কারণ। প্যাটারসন অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তার আইনজীবীদের দাবি, এটি নিছক একটি ‘দুঃখজনক দুর্ঘটনা’। প্যাটারসন নিজেও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বিষক্রিয়ার মৃত্যুর কথা শুনে ‘অবাক’ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন—এমন একটি ভিডিও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তদন্তকারীরা এরিন প্যাটারসনের কম্পিউটারে ডেথ ক্যাপ মাশরুম সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের প্রমাণও পেয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারপ্রক্রিয়ার পঞ্চম সপ্তাহে প্রবেশ করেছে এবং তা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক পডকাস্ট ও ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

াি

ছবি: প্রাণ হারিয়েছেন এরিন প্যাটারসনের সাবেক শশুর ডন প্যাটারসন, শাশুড়ী গেইল প্যাটারসন (উভয়ই ৭০ বছর বয়সী)

একটি সাক্ষ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর আগে একজন ভিকটিম নাকি বলেছিলেন, ‘খাবারটি দারুণ সুস্বাদু ছিল।’ সেই একটি পারিবারিক খাবার এখন রূপ নিয়েছে রহস্য, মনস্তত্ত্ব, ধর্মান্তর, সম্পর্কের জটিলতা ও হত্যার অভিযোগে জর্জরিত এক জটিল আইনি নাটকে। 

মাশরুম হত্যা’ মামলায় সাক্ষ্য দিলেন একাধিক ব্যক্তি, উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

অস্ট্রেলিয়ার বহুল আলোচিত ‘মাশরুম হত্যা’ মামলায় গত কয়েক সপ্তাহে একাধিক সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে সেই রহস্যময় বিষক্রিয়ার লাঞ্চের পেছনের ঘটনা। অভিযুক্ত এরিন প্যাটারসনের বিরুদ্ধে তিনজনকে হত্যা ও একজনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

নিচে তুলে ধরা হলো আদালতে এ পর্যন্ত উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাক্ষ্য

বিরল সামাজিক আয়োজন

এরিন প্যাটারসনের সাবেক স্বামী সাইমন প্যাটারসন আদালতে বলেন, তার সাবেক স্ত্রীর বাড়িতে সামাজিক আয়োজন ছিল ‘অত্যন্ত বিরল’ ঘটনা। সাইমন নিজেও সেই লাঞ্চে আমন্ত্রিত ছিলেন, তবে অনুষ্ঠানের আগের দিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন না যাওয়ার—যে সিদ্ধান্ত তার জীবনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে।

আলাদা বিফ ওয়েলিংটন পরিবেশন

এ ঘটনায় একমাত্র জীবিত অতিথি ইয়ান উইলকিনসন আদালতে বলেন, প্যাটারসন নিজ হাতে ‘সব খাবার পরিবেশন’ করেছিলেন এবং প্রত্যেকেই পেয়েছিলেন আলাদা করে পরিবেশন করা বিফ ওয়েলিংটন। তিনি আরো জানান, এরিন নিজে একটি আলাদা প্লেট থেকে খাচ্ছিলেন, যা অন্যদের প্লেট থেকে ভিন্ন ছিল।

ফেসবুক গ্রুপের তথ্য

 ট্রু-ক্রাইম ফেসবুক গ্রুপের সদস্য ক্রিস্টিন হান্ট আদালতে জানান, সেই গ্রুপে এরিন তার স্বামী সাইমনকে ‘নিয়ন্ত্রণকারী’ ও ‘জবরদস্তিমূলক’ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, দম্পতিটি ২০১৫ সালেই স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যায়।

মাশরুম শুকানোর যন্ত্র

একই গ্রুপের আরেক সদস্য ড্যানিয়েলা বার্কলি বলেন, এরিন একটি মাশরুম শুকানোর যন্ত্র (ডিহাইড্রেটর) কেনার জন্য উৎসাহী ছিলেন। আদালতে গ্রুপে শেয়ার করা একাধিক ছবি উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সেই যন্ত্রে ধাতব তাকের ওপর মাশরুম শুকাতে দেখা যায়।

কম্পিউটার ও মোবাইলের ফরেনসিক বিশ্লেষণ

এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আদালতে জানান, ২০২২ সালে এরিন প্যাটারসনের কম্পিউটার থেকে ‘ডেথ ক্যাপ’ মাশরুম দেখার একটি স্থানীয় প্রতিবেদন খোঁজা হয়েছিল।

প্রসিকিউশন আরো জানায়, এরিনের মোবাইল লোকেশন ডেটা অনুযায়ী, তিনি সেইসব এলাকায় গিয়েছিলেন, যেখানে আগেই বিষাক্ত মাশরুম দেখা গিয়েছিল—এবং তা ছিল এই আয়োজনের কয়েক মাস আগেই।

এই সব তথ্য আদালতের বিচারকদের সামনে মামলার একটি ধাপে ধাপে জট খুলে দিচ্ছে। তবে এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—এই ঘটনাটি দুর্ঘটনা ছিল নাকি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড—তা প্রমাণের জন্য আদালতের বিচার অব্যাহত রয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি সাধারণ জনগণের নজর যেমন বাড়ছে, তেমনি মামলাটি হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত একটি বিচারিক নাটক। মামলার বিচারকাজ চলাকালে ইতোমধ্যে এক জুরি সদস্যকে অনিয়মের কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং মামলাটি ‘ম্যানুপুলেটেড’ বলে অভিযোগ তুলে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ হয়েছে। এর ফলে কিছু সময়ের জন্য বিচার প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। 

এই বহুল আলোচিত মামলার রায় জুন মাসে প্রত্যাশিত। তবে যেভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে এবং গণমাধ্যম ও জনসাধারণের আগ্রহ বাড়ছে, তাতে এই মামলার আলোচনা শিগগিরই থামার কোনো লক্ষণ নেই।

সূত্র : বিবিসি, এবিসি নিউজ

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন