নারী ভুল করতে পারে, শৃঙ্খলা ভাঙতে পারে এবং সাংঘাতিক বর্বরতা চালাতে পারে—এই বিশ্বাস সমাজ-সংসারে নেই
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
জাহিলিয়াতের যুগে নারীদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে সেটার কাফ্ফারা আদায় হচ্ছে নারীকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে। যুগের ধর্ম এই—পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই। নারীর এই অবাধ স্বাধীনতায় যারা ভালো ও বুদ্ধিমান নারী তারা আলোর মালিক হয়েছে, যশ-খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যারা অসৎ, তারা এই সুযোগকে অপব্যবহার করেছে। পুরুষের ভাগ্যে টেনে দিয়েছে পুরুষ নির্যাতনের চাদর।
নারী নির্যাতন রোধকল্পে রাষ্ট্রের কঠোর আইন আছে, সামাজিক প্রতিকার আছে এবং পারিবারিক আশ্রয় আছে। কিন্তু পুরুষের ভাগ্য রোজ দুর্ভাগ্যে পরিণত হচ্ছে। এতদিন যে নির্যাতনের কথা গোপন ছিল, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে প্রকাশ্যে আসছে এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ। পুরুষকে সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। পুরুষের জন্য প্রতিকার পাওয়ার কোনো দরজা উন্মুক্ত নয়। নারী-পুরুষের তথা দাম্পত্যের কলহের কথা প্রকাশিত হলে প্রথমে পুরুষকে দোষী ধরেই বিচার করা শুরু হয়। এই বিচারিক কার্যক্রম কেবল আদালতেই চলছে না, বরং সামাজিক বিচার-ফয়সালা কেন্দ্রে, পারিবারিক বিবাদ মীমাংসা বৈঠকে কিংবা কারো সাথে আলোচনাতেও একই চিত্র।
নারী ভুল করতে পারে, শৃঙ্খলা ভাঙতে পারে এবং সাংঘাতিক বর্বরতা চালাতে পারে—এই বিশ্বাস সমাজ-সংসারে নেই। সমাজ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, সেজন্যও দোষের প্রাথমিক ভাগীদার পুরুষ। তাকে সবকিছু সহ্য করতে হবে, সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও অন্যদের সন্তুষ্ট করতে হবে এবং সেক্রিফাইজের পিরামিড গড়তে হবে। ঘরে ঘরে পুরুষের ওপর যে নির্যাতনের নীরব স্টিমরোলার বইছে, তাতে নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য সংঘর্ষে পরিণত হতে খুব বেশি সময় নেবে না।
ভালো আইন কেবল একপাক্ষিক স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না। অথচ মানুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে কেবল নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন আছে। নারীর সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করার জন্য এই আইনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পুরুষের মধ্যে বর্বরতার স্বভাব, পৈশাচিকতা এবং লোভ এখনো বিদ্যমান। পারিবারিক রেওয়াজ এবং সামাজিকতার নামে অসামাজিক যৌতুক প্রথার কবলে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার হার এখনো অনেক বেশি।
দুর্বলকে সবলের দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি সেই আদি লগ্ন থেকে। পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে সমাজকাঠামোয় অনেকগুলো স্তর বিদ্যমান থাকায় পুরুষের সভ্যতারও রকমফের আছে। কোনো কোনো সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করাও নির্যাতনের নামান্তর, আবার কোথাও কোথাও দু-চারটা চড়-থাপ্পড় পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রচলন। তবুও নারীর প্রতি যাতে কোনো দেহিক ও মানসিক প্রকারের নির্যাতন না হয়, অন্যায্য চাপিয়ে দেওয়া না হয়—সেজন্য আইনে সুরক্ষা ও প্রতিকারের কথা বলা আছে।
শুধু নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য স্বতন্ত্রভাবে পারিবারিক আদালত গঠন করা হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। যুগে যুগে নারীরা যে পরিমাণ নির্যাতিত ও নিগৃহীত, তাতে পুরুষগণ নারীদের প্রতি অবিচারই করেছেন বটে। তবে নারী শিক্ষার হার বাড়ার কারণে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে নারীর শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা কমে এসেছে। এই প্রজন্মের অংশীদার হিসেবে আশা করি, অচিরেই নারী মানসিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সৃষ্টি হবে।
ভদ্র সমাজের পুরুষরা বেশ নির্যাতিত। শুধু স্ত্রী কর্তৃক নয়, বরং কখনো কখনো স্ত্রী-পক্ষের দ্বারাও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সমাজে যে পরিমাণ পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তার সিকিভাগও প্রকাশে আসে না। যেহেতু নারীর দ্বারা পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টিকে পুরুষত্বের প্রতি লজ্জা ও বিদ্বেষ হিসেবে দেখা হয়, সেহেতু অনেকেই সহ্যসীমা পর্যন্ত প্রকাশ করেন না।
যখন পরিস্থিতি পুরুষকে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে দেয়, জীবন প্রায় যায় যায়, তখনও কেউ কেউ মুখ খোলে; অনেকেই না। দাম্পত্য কলহকে অনেকেই সম্মানের প্রশ্নে প্রকাশ করেন না। এমনকি যে পুরুষ নির্যাতিত, সে নিজের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের সাথেও এইসব বিষয় শেয়ার করে না। মানুষ হিসেবে যাদের জাত ভালো, সেটা পুরুষ হোক কিংবা নারী, তাদের সংসারে শান্তি থাকলেও কিছু কিছু বেজাত অশান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
ফৌজদারি অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে নারীদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে, প্রতারণার ক্ষেত্রেও অনেক নারী জড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই সেই সব নারী যখন পরিবারের অংশ, তখন তাদের দ্বারা বাবা-ভাই, বিশেষত স্বামী নিরাপদে আছে—এমনটা ভাবা ঠিক নয়। শুধু মানসিকভাবে নয়, অনেক নারী সংসারে স্বামীকে দৈহিক নির্যাতনও করে। খুন-জখম করার খবর পর্যন্ত পত্রিকা-মিডিয়ায় আসে। এইসব অপরাধকে কেবল ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই, বরং সংসার ও সমাজে পুরুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা জরুরি।
সমাজের সর্বত্রই নারী-পুরুষের সমান অংশীদারত্ব বাড়ছে। কোনো কোনো সূচকে পুরুষকে পেছনে ফেলে নারী এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত সুখবর যে, এই সূচকসমূহের প্রায়গুলোই নারী প্রগতির পক্ষে ইতিবাচক। শিক্ষায় নারী অভূতপূর্ব উন্নতি করছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা, এমনকি রাজনীতিতেও নারীদের অংশগ্রহণ সাড়া ফেলছে। নারী-পুরুষ প্রতিযোগী না হয়ে সহযোগী হলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই।
তবে প্রত্যেক আলোকের বিপরীতে একটা অন্ধকার দিক থাকে। সেই অন্ধকারে পুরুষ অন্যায়-অবিচারের বলি হচ্ছে। শুধু মানসিকতার দৃঢ়তায় পুরুষ শক্তিশালী না হলে, পুরুষের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি হতো। পুরুষের সামর্থ্য নিয়ে কটূক্তি, পুরুষের চরিত্র নিয়ে মনগড়া উক্তি—এসব মানুষ হিসেবে কাউকে দায়মুক্তি দেবে না। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে আইন ও আদালতের যে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি, তা জাতিকে সামনের দিকে নিচ্ছে না, বরং পিছিয়ে দিচ্ছে।
অপরাধ প্রবণতা নারী ও পুরুষ উভয়ের মাঝেই আছে। প্রেম-ভালোবাসার সাথে চরিত্রের নৈতিক দিকগুলোও সমানুপাতিক। পূর্বপুরুষরা নারীদের প্রতি অন্যায় করেছে, নির্যাতন করেছে এবং স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে—এই অভিযোগের ক্ষতিপূরণ নিশ্চয়ই এই প্রজন্ম আদায় করবে না। মানুষ হিসেবে তাতে সে নারী কিংবা পুরুষ হোক—যার যেটুকু অধিকার ও স্বাধীনতা, সেটুকুই তার প্রাপ্য। সভ্যতার এই উৎকর্ষে যখন সেটা বাধাগ্রস্ত করা হবে এবং কাউকে একপাক্ষিক সুবিধা দেওয়া হবে, তখন সেটা ক্রোধ ও বিরোধের সৃষ্টি করবে।
মানবসভ্যতায় নারী পুরুষের শত্রু হয়ে কিংবা পুরুষ নারীর প্রতিযোগী হয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হলে তবেই উত্তম ও কল্যাণকর কিছুর প্রত্যাশা করা যায়। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূচনার এই সময়টাতে মানসিক জটিলতা বাড়ছে। কাজেই বিচ্ছেদের হার কমানোর জন্য, নীড়ে শান্তি প্রবাহিত রাখতে নারী ও পুরুষ তথা মানুষের প্রত্যেককে তার অধিকার সীমানায় সুরক্ষিত রাখার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা তথা আইন দরকার।
যে সমাজে নেশার ছোবলে পুরুষের পাশাপাশি নারীও সংক্রমিত, যেখানে ভাইরালের নেশায় প্রজন্ম উদ্বেলিত, সেখানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের সাথে সাথে পুরুষ নির্যাতন রোধ আইন প্রণয়ন করা জরুরি। দুই দশক আগের সমাজের সাথে বর্তমান সমাজকে তুলনা করে বসে থাকলে ভুল হবে। গড় আয়ুতে নারীর চেয়ে পুরুষের প্রায় চার বছর কম বাঁচার কয়েকটি কারণ দেখান। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ঘরে পুরুষের নির্যাতিত-নিপীড়িত হওয়ার চিত্র ফুটে উঠবে।
ভালোদের নিয়ে কোনো সমাজেই সামান্য অভিযোগ নেই। আইন মূলত ভালোদের জন্য দরকার পড়ে না। যারা বিবেক ও মূল্যবোধহীন, ধর্ম ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত, তাদেরকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে আইন জরুরি। পুরুষকে সুরক্ষার জন্য শুধু প্রচলিত সাধারণ আইনের প্রতি আস্থা না রেখে বিশেষ আইন প্রবর্তন করা সময়ের দাবি। পারিবারিক শান্তির জন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য জরুরি। রাষ্ট্র যদি কাউকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে রাখে এবং সে যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে সেই সুযোগের অপব্যবহার করে, তবে যে কারো জীবন নরকের পরিণত হওয়ার সময়ের ব্যাপার মাত্র। আশা করি রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টিকে আমলে নেবেন। জাতীয় কবির নারী কবিতার মতো এখন কোনো পুরুষ কবিতা লেখাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন