হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলে ভোগান্তি। পরিবহণ সেক্টরে গেলে সিন্ডিকেট। বাজার ব্যবস্থা মনোপলির দখলে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। |
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ১৯০ বছর ধরে লুটতরাজ চালিয়ে নিজেদের দেশকে মনের মতো করে সাজিয়েছে। উপমহাদেশ থেকে চুরি করা কোহিনুর মুকুট শোভা বৃদ্ধি করছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের পুত্রবধূদের মাথায়! সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজ সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য দূর করে সমৃদ্ধ করা। চেঙ্গিস খানের দুর্নাম বিশ্বব্যাপী, অথচ মঙ্গোলীয়দের কাছে তিনি জাতীয় বীর। এটাকেই বলে দেশপ্রেম। রবিনহুডের লুটতরাজ ছিল গরিবকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে। অথচ বাঙালি? নিজের দেশে যারা চুরি করে বিদেশে পাচার করে, নিজের ঘরে যারা ডাকাতি করে সম্পদশালী হয়—এদেরকে কি দেশপ্রেমিক বলা যাবে? নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা আত্মঘাতী বাঙালির প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও হাল আমলের সাথে শিক্ষা প্রাসঙ্গিক—যে জাতি সৌন্দর্য বোঝে না, যাদের রুচি দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত এবং যারা নিজেদের সম্পদ লুটতরাজ করে, তারা আত্মঘাতীই বটে। টাকা ও ক্ষমতা যাদের অন্ধ করে, ভোগ ও স্বার্থ যাদের অমানুষ বানায়—তাদের দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। যারা বিক্রি হওয়া বিবেক দিয়ে চলে, যারা আইন ও শৃঙ্খলাকে শত্রু মনে করে—তারা দেশ ও জাতির প্রকাশ্য শত্রু।
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের বিকল্প নাই। অথচ মরণঘাতী রাসায়নিকে খাদ্যের শরীর ও স্বাস্থ্য ভরা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিক, চোখের সীমায় অসংখ্য ফার্মেসি—সবই খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দরকার পড়ছে! অসুখ এখন বিক্রি হয় হাজার কোটির বাণিজ্যে- ভোক্তাও মানুষ, ক্রেতাও মানুষ! বাজারের সবকিছুতে ভেজালের সয়লাব। খাঁটি কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ক্রেতাকে বিশ্বাসে বাধ্য করাতে বিক্রেতার উচ্চারিত “খাঁটি” শব্দটুকুতেই যা স্বস্তি। নয়তো মাছ, মাংস, সবজি কিংবা চাল—কোনোকিছুই ভেজালমুক্ত নয়। শতভাগ খাঁটি মাটিকেও রাখেনি বাঙালি! কবি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি!" উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষক থেকে শুরু করে বিপণনকারী পর্যন্ত সবাই ভেজাল মেশাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন ঘিরে ধরে তখন একেকজন ভেজা বিড়ালের মতো সাজে—যেন দুধের শিশু, কিছুই বোঝে না। অথচ এরাই শিশুখাদ্যেও ভেজাল দেয়। মানুষ যাবে কোথায়? যা খেয়ে বাঁচার, সুস্থ থাকার এবং স্বাস্থ্য গঠনের স্বপ্ন দেখে, সেসবই অসুখ ডেকে আনে। খাদ্য খাচ্ছি নাকি বিষ—সেটার ফয়সালা হওয়া দরকার। মস্তিষ্কের ক্যান্সার এখন শরীরের ক্যান্সারকে বেগবান করছে। অথচ দায়িত্বশীলগণ কারো প্রশ্নের কোনো এ্যান্সার দিতে চাচ্ছে না বা পারছে না।
হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলে ভোগান্তি। পরিবহণ সেক্টরে গেলে সিন্ডিকেট। বাজার ব্যবস্থা মনোপলির দখলে। সব ছেড়ে ছুঁড়ে পাহাড় কিংবা সাগরে গেলেও দেখা যাবে—ওখানে যারা সেবা দেওয়ার নাম করে বসেছে বা দায়িত্ব নিয়েছে, তারা পর্যটকদের ঠকাতে ও ভোগান্তিতে ফেলতে একাট্টা। বৃহদাংশ মানুষ কতিপয় অমানুষের কাঠগড়ায় জিম্মি। যে যার স্বার্থ বুঝে নিতে ব্যস্ত। জাতীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে অথচ জনতা সেটাকে সরকারের সম্পদ ভেবে চুপ করে আছে। নদী দখল হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে কিংবা পরিবেশের শত্রু পলিথিনের দেদারসে অপব্যবহার—অথচ ভালো মানুষগুলো প্রায় নীরব। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেওয়ার কারণে যে বিপর্যয় তৈরি হবে, জীববৈচিত্র্য বিলীন হবে—তাতে সৃষ্ট মহাদুর্যোগের কবল থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। কুমিল্লায় ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে সৃষ্ট বন্যায় বরিশালে বসে আমি চুপ করে থাকতে পারি, তবে সেখানকার বন্যায় ক্ষতি হওয়া ধানের রেশ আমার কাছে এসে চালের চড়া দামে শোধ হবে!
কী হচ্ছে চারদিকে? আমরা তো আশ্বস্ত করাকে বিশ্বাস করেছিলাম এবং স্বস্তি আশা করেছিলাম। সাদা পাথরের সৌন্দর্য নষ্ট করতে, সেখানে লুটপাট চালাতে যে ঈমাম ইমামতি করেছে তার জানাজা কি নিশ্চিত হয়েছে? দায়িত্বশীলদের আসলে দায়িত্ব কী? চোখের সামনে শত শত নৌকায় হাজার হাজার টন পাথর লুট হয়ে গেলো অথচ ফেসবুকে সাড়াশব্দ ছাড়া আর কোনো প্রতিকার নেই? হজের সময় মিনার জামারাতে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে পাথর নিক্ষেপের মধ্যে মানুষের জন্য কোনো শিক্ষা নেই? যারা মানবতার বিরুদ্ধে যাবে, চাঁদাবাজি ও লুটতরাজ করবে, স্বার্থের জন্য সম্পদ ও সৌন্দর্য নষ্ট করবে এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে—তাদের প্রয়োজনে পাথর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করতে হবে। শক্তিশালী হাত শরীরের সাথে আছে না? পাথর তো জমিনে বিছানার মতো বিছানো। কাজেই হাতে নিন এবং চোরদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করতেই থাকুন। যতক্ষণ অনাচার বন্ধ না হয়, ততক্ষণ জাগ্রত থাকতে হবে। বিবেককে ঘুমাতে দিলে সর্বনাশ নেমে আসবে।
মুখের নীতিকথা এবং কাজের ধরনে বিস্তর ফারাক দেখি। নিজের দেশকে শ্মশানে পরিণত করতে কেউ এভাবে উঠেপড়ে লাগে? ভোলাগঞ্জে সাদা পাথরে এখন মরুভূমির ছাপ। চোরদের জাতীয়ভাবে শাস্তিস্বরূপ লজ্জা দিতে হবে। সকল ধরনের অন্যায়কারীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। যাদের চোখ অরুচির রোগে ধরেছে, যাদের মন লোভে গ্রাস করেছে—তারা জাতি ও জাতীয়তার শত্রু। আইন ও আদালতকে এদের ব্যাপারে চোখ খুলতে হবে। দেশটাকে বাসযোগ্য করতে হবে।
প্রজন্মের অনেকেই এ দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ঘৃণা করে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে। যারা বাধ্য হয়ে এখানে আছে তারাও বারবার ভাগ্যকে উপহাস করছে। লুটেরা-বদমাশ শ্রেণি যাতে সমাজের কর্তৃত্ব না পায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যে দেশে বিএ-মাস্টার্স পাশের অভাব নেই, সে দেশে এইট পাশ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের নিয়মই অনেক অনিয়মের সূতিকাগার। মৌলিক সংস্কার ছাড়া কোনো স্বপ্ন পূরণের আশা নেই। কেবল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ দেশ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাবে না। জনতার বিক্রি করা রায়, স্বার্থান্ধ ও স্বার্থান্বেষী শ্রেণীর সম্পর্ক ও চাওয়া টাকায় দফারফা হওয়া—আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। এ থেকে যে-কোনো মূল্যে মুক্তি দরকার।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন