কার মর্যাদা কোথায়, কার বেতন কত—এই চিন্তার দরকারটা কী?
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
বেতনের ক্ষেত্রে দেখি— আমার ওপরের জনকে কত দেয় আর নিচের জনে কত পায়! তারপর আমার মর্যাদা মাপি! গ্রেডের ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড! অথচ আমার ভাবা উচিত ছিল—আমি যা পাই, তা আমার জন্য যথেষ্ট কি না। যা কামাই করি তা যোগ্যতার সাথে যুৎসই কি না! একজন ১৩ গ্রেডের লোক আমার কাছাকাছি আসবে কেন—সেই দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না! একজন ৪র্থ গ্রেডের বেতনের সাথে আমার মজুরির এত তফাৎ কেন—সেই ঈর্ষায় তাকেও আপন ভাবি না! এই যে এর-ওর সাথে তুলনা করে ভালো থাকতে চাই—এ জন্যই সবচেয়ে খারাপ আছি! অথচ আমি কেবল আমার জীবনটাকেই ধারণ করি।
কার মর্যাদা কোথায়, কার বেতন কত—এই চিন্তার দরকারটা কী? আমার চিন্তা হবে আমি কেমন আছি—সেটা। কে কতদূর থেকে এসে আমাকে স্পর্শ করল, করলে সেটা কেন করল—এই অহেতুক প্যাচালে মস্তিষ্ককে জর্জরিত করি। ৯ম গ্রেড কেন ১০ম গ্রেডের অনেক দূরে—সেটা অমীমাংসিত! গ্রেড দিয়ে পদ-পদবি আর বেতনের কম-বেশি মাপা যায়, কিন্তু মানুষ মাপা যায় না। কোনো গ্রেডে না থেকেও, কোনো বেতন না পেয়েও কত যে ভবঘুরে বড় বড় মানুষ—তা আন্দাজ করাও যাবে না!
আমরা জাতি হিসেবে ঈর্ষাপরায়ণ এবং দাম্ভিক। নিজের উন্নতি নিয়ে যতটা না ভাবি, তার চেয়ে অন্যের উন্নতি দেখলে বেশি ভেঙে পড়ি। কারো শুভ সংবাদে শুভকামনা জানাতে কলিজা পোড়া গন্ধ বের হয়। কেউ আমার সমকক্ষ হোক, কেউ আমার চেয়ে বেশি আয় করুক কিংবা কেউ বেশি সুখে থাকুক—কষ্মিণকালেও সেটা চাই না। সমাজের চাপে মুখে হাসি রাখলেও অন্তর দগ্ধ হয়! অনেক পেশাজীবী বেতন ও বাড়িভাড়া বাড়ানোর আন্দোলন করছে—অথচ আমরা তাদেরকে শত্রু ভাবছি! এই শত্রুতার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই! তবে কারণ কী? সে আমাকে স্পর্শ কেন করবে? মর্যাদা সমান হয়ে যাবে—এটা মানা যায় না!- এই যা!
নিজেদের উন্নতিকল্পে যতটা না পরিশ্রম করি, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করি অন্যের সমালোচনায়! কাকে কীভাবে বেইজ্জতি করা যায়, কাকে কোন পথে ঠকানো যায়—এইসব বুদ্ধি মগজে গিজগিজ করে। অপরের নামে কুৎসা রটাতে, পরিহাস ছড়াতে বাঙালি অপ্রতিরোধ্য। বাঙালির কিছু স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য প্রকৃত মানুষকে বিচলিত করার কথা! নয়তো কারো উন্নতি-অগ্রতির সামনে কেউ এভাবে পথরোধ করে দাঁড়ায়, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে বেতনে কুলাচ্ছে না—সেটা না বিশতম গ্রেডের, না ১০ম গ্রেডের কিংবা না প্রথমের! চাইছি—দুই প্রান্তের বৈষম্য কমে আসুক এবং সর্বনিম্ন যে, সেও যাতে বেতন দিয়ে সমাজে সম্মানজনকভাবে বাঁচতে পারে—সেটার ব্যবস্থা হোক। কে কার কত কাছে চলে আসল—সেটা নিয়ে হইচই অহেতুক। ছোটলোকি মনমানসিকতার পরিচায়ক।
অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শান্তির সুবাতাস ছড়ানো যাবে না। ঘুষ-দুর্নীতির লাগাম টানতেও কাঙ্ক্ষিত বেতন দেওয়া লাগবে। একটা চাকরি মানে তার পেছনে একটা সমস্ত পরিবার। সন্তানকে আমিষে লালন করতে, বয়োবৃদ্ধদের সুচিকিৎসা দিতে এবং সমাজে সামাজিকতা নিয়ে বাঁচতে যেটুকু দরকার—সেটুকুর নিশ্চয়তা রাষ্ট্র এবং সরকার দেবে। রাষ্ট্রে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজমান—তার অন্তরালেও কলকাঠি নাড়ছে অর্থনৈতিক মুক্তি তথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং স্বনির্ভরতার অনুপস্থিতি। বস কিংবা পিয়ন—সমাজে যাতে প্রত্যেকেই সম্মান নিয়ে মানুষ পরিচয়ে বাঁচতে পারে, মৌল মানবিক চাহিদা সুনিশ্চিত হয়—সেটুকুর নিশ্চয়তা চাই। গ্রেডের চেয়েও বেশি বিবেচনা হোক প্রচলিত বাস্তবতা। মাছ-ভাত, কাপড়, বাসস্থান ও সুরক্ষার জন্য যতটুকু সামর্থ্যবান প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের করা দরকার—তা যেন করা হয়। কেউ যেন কারো পথ না আটকায়! কারো কারো স্বভাব ভালো না!

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন