জিবি নিউজ প্রতিনিধি//
সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর টিলা ধসে নিহত হচ্ছেন তবু টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস থামছে না। টিলার পাদদেশে দিনে বসবাস করলেও রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যান বসবাসকারীরা। ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরাও এই মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে দিন পার করছেন দেদারসে। যেকোনো অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রসাশন থেকে কিংবা সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে মাইকিং করা হয়। কিন্তু এর আগে কোনো ধরনের নির্দেশনা কিংবা কোনো ধরনের ঝুঁকি সম্বলিত প্রচার-প্রচারণা করা হয় না। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত টিলায় ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন ৩৮৬টি পরিবারের কয়েক হাজার লোকজন। বিভিন্ন সময় সিলেটের পাহাড় টিলা ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে। ফলে প্রাণহানির শঙ্কাও বেড়েছে কয়েকগুণ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার তথ্যমতে, এভাবে টিলা কাটা এবং সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাসবাসের কারণে মাটি ধসে গত সাড়ে তিন বছরে সিলেটে বিভাগে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রশাসন দেখে না; কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে এমন অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। তারা বলছেন, ‘এসব টিলা যখন কাটা হয়, তখন খুব নজরদারি চলে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এসব করা হয়। কেউ কেউ টিলার মাটি ব্যবহার করছেন নতুন বাসাবাড়ির ভিটা তৈরিতে। প্রত্যেক বাসার পেছনে রয়েছে টিলা কেটে ফেলে রাখা মাটি। টিলার মাটি কাটতে কাটতে বাসার পেছনের জায়গা বড় হচ্ছে দিন দিন। অপরিচিত লোক দেখলে এলাকার বাসিন্দাদের চোখেমুখে ভয় কাজ করে। তারা অপরিচিত লোকজনের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। আশপাশের বাসিন্দারা দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। রাতের বেলা টিলার কাটা মাটি ট্রাকে করে পরিবহন করা হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরীর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ’ পরিবার। এছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার মানুষজন।
সিলেট নগরীর উপকণ্ঠে ছোট ছোট টিলা দিয়ে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর এলাকা। টিলার পাদদেশে রয়েছে বেশ কিছু কাচা, আধাপাকা ও টিনসেডের বাড়ি-ঘর। এসব বাড়িঘর নির্মাণ করতে গিয়ে টিলা কাটতে হয়েছে এটা বোঝাই যাচ্ছে। এমন একটি বাড়ির পাশের কিছুটা জায়গা টিনের বেড়া দেওয়া। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী হচ্ছে। সামনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু লোক টিলার একপাশে শাবল চালাচ্ছেন। মাঝখানে কিছুটা গর্তের মতন হয়েছে। একজন জানালেন, টিলার মাঝখানে এভাবে গর্ত করে রাখলে, সেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়। সেই পানি টিলার ভেতরে ঢুকে মাটি নরম করে ফেলে। তখন কাটতে সুবিধা হয়। সেই মাটি কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয়। জায়গাটি খালি হয়ে যায়। তখন সেখানে বাড়িঘর ওঠানো হয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় মাটি নরম করে টিলা কাটার বড় বিপদ হচ্ছে, বর্ষাকালে ধসের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। তখন আশপাশের বাড়ির ওপর মাটি ধসে প্রাণহানি ঘটে। সেটা এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সিলেটে কি পরিমাণ লোক টিলার পাদদেশে বসবাস করেন সরকারিভাবে তার কোনো তালিকা নেই, তবে বেসরকারি হিসেবে সিলেটে প্রায় ৩৮৬টি পরিবার টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সিলেটের দেয়া তথ্য মতে, সিলেটে সর্বমোট টিলার সংখ্যা রয়েছে ২৭৯টি। তারমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ টিলা রয়েছে ১৬৯টি। এই ১৬৯টি ঝুঁকিপূর্ণ টিলার মধ্যে ৩৮৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবার করছেন। তারমধ্যে সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ৫টি টিলায় ৭টি পরিবার এবং উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭১টি টিলায় ৮৮টি পরিবার, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৯টি টিলায় ৯টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলায় ১টি টিলায় ৩টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলার মোট ৭৫টি টিলার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলায় ৩টি পরিবার বসবাস করছে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের ১২টি টিলায় ৩৮টি পরিবার বসবাস করছে, বিশ্বনাথ উপজেলার ১টি টিলায় ৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন, সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগরে ২৫টি টিলায় মোট ৭০টি পরিবার, খাদিমপাড়ায় ১৫টি টিলায় মোট ৩৯টি পরিবার, টুকেরবাজার ২০টি টিলায় ১২৫টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।
অন্যদিকে সিলেটের জকিগঞ্জে ৯টি টিলা এবং গোয়াইনঘাট উপজেলা পূর্ব জাফলংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলাসহ মোট ২৭টি টিলা রয়েছে কিন্তু ওই টিলাগুলোতে কোনো জনবসতি নেই বলে জানা যায়। সিলেটে প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিপাতে বিভিন্ন টিলা-পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায় এবং মাটি ধসে ছোট-বড় নান দুর্ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের ট্যাজেডির সৃষ্টি হয়। গত ১০ বছরে সিলেট বিভাগে টিলার মাটি ধসে অন্ততঃ অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
ধসের ঘটনাগুলোর জন্য টিলা-পাহাড় কর্তনকেই মূলতঃ দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সিলেটে কিছুতেই বন্ধ হয় না টিলা ও পাহাড়ের মাটি কাটা। সর্বশেষ শনিবার (১ জুন) সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে পড়ে এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। দিবাগত রাত দুইটার দিকে উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের ঢাকা দক্ষিণ বখতিয়ারঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গতবছর সোমবার (১০ জুন) সিলেট মহানগরীর মেজরটিলার চামেলীভাগ আবাসিক এলাকায় টিলা টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন।
এতে আহত হন আরও তিনজন। নিহতরা হলেন- আগা করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রুজি (২৫) ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম । একই স্থানে টিলা ধসে ১৯৯৭ সালে প্রাণ হারিয়েছিলেন হুনদা নামের এক যুবক। এদিকে, প্রতি বর্ষা মৌসুমে সিলেট জেলায় টিলা-পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেও এগুলোর পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন মানুষজন। ফলে প্রতি বছরই সিলেটে ঘটে টিলা বা পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা। মহানগরীসহ সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলায় কয়েক বছর আগেও মানুষের তেমন আনাগোনা ছিলোনা কিন্তু এখন এই সকল সেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ঘনবসতি।
সিলেট মহানগরীর ৬নং টুকেরবাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, ‘বৃষ্টিতে টিলার পাদদেশে দিনে বসবাস করলেও রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যান। ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরাও এই মৃত্যু ঝুঁকিতে দিন পার করছেন। বর্ষা মৌসুম আসার আগে কিংবা কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও প্রসাশন ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় না। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রসাশন থেকে মাইকিং করা, এবং টিলায় না থাকার জন্য বলা হয়। কিন্তু এরআগে কোনো ধরনের নির্দেশনা কিংবা কোনো ধরনের ঝুঁকি সম্বলিত বিলবোর্ড টানানো হয় না।’

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন