আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা যেন কাটছেই না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে শুরু হয়েছে নানামুখী প্রস্তুতিও। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। নির্বাচনি মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি প্রার্থী বাছাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও এগিয়ে রাখছে অনেকেই। তবুও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না-এ নিয়ে সন্দেহ-শঙ্কা দূর হচ্ছে না। ভোটের মাত্র সাড়ে তিন মাস থাকলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোটসহ নানা ইস্যুতে এখনো দ্বিধাবিভক্ত দলগুলো। একদিকে দলের নেতারা সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, অন্যদিকে প্রকাশ্যে একে-অন্যের দোষারোপও করছেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে তুলছেন নির্বাচন বানচালের প্রেক্ষাপট তৈরি এবং ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগও। বিশ্লেষক ও রাজনীতিকরা বলছেন, সরকারকে অবশ্যই নিজেদের নিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখতে হবে। অন্যথায় নির্বাচন অনিশ্চয়তায় পড়ার শঙ্কা আছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শুরুতে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। সরকারের পক্ষ থেকে তখন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়। তবে গত জুনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যুক্তরাজ্যেই সরকার ও বিএনপি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন প্রশ্নে যৌথ ঘোষণা দেয়। এ সময় জুলাই গণহত্যার বিচার শেষ করাসহ বেশকিছু শর্তও উঠে এসেছিল। এরপর থেকে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে। এ নিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল দলগুলোও। কিন্তু বর্তমানে বেশকিছু ইস্যুতে নেতাদের বক্তব্যেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া পর্দার অন্তরালেও নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন আছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই এ মুহূর্তে মূল বিষয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো অসহযোগিতা করলে সরকার বিপদে পড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের নিরপেক্ষতার জায়গাগুলোয় শক্তভাবে হাত দিতে হবে। অনেকদিন পর একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্ন আমাদের সামনে এসেছে। ফলে এই দাবি তো যৌক্তিক। এ বিষয়গুলো সরকারকে বিবেচনায় নিতেই হবে বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে। বেশকিছু দিন ধরেই কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছে দল দুটি। যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সর্বশেষ পৃথক বৈঠকেও দল দুটির আলোচনায় সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ এবং তাদের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যাওয়ার’ প্রসঙ্গ উঠে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতেও দলগুলো নানা ধরনের অভিযোগ করছে একে অন্যের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বানচাল ও ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গও আসছে তাদের বক্তব্যে।
রোববার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমরা দেখছি, যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা দেখছি, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সেই প্রোপাগান্ডা, মিথ্যা প্রচার। এর মধ্য দিয়ে দেশে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে।’
এর আগে শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি নতুন করে যে পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেটি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। জনগণ ফেব্রুয়ারিতে একটি জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছে। নির্বাচনের ঠিক আগে হঠাৎ এরকম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উত্তাপ তৈরি করা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে বলেই আমরা মনে করি। এরকম অশুভ চক্রের কাছে প্রধান উপদেষ্টা নতি স্বীকার করবেন, বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং ষড়যন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করে উনি সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবেন-এটি আমরা আশা করি না।’
রোববার বাংলামোটরে দলের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের শুরু থেকেই মৌলিক বিষয়গুলোয় নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছে। ফলে সংস্কারের পক্ষে তারা কতটুকু আছে, এ বিষয়ে জনগণের ভেতর প্রশ্ন আছে, আমাদের কাছেও প্রশ্ন আছে। অন্যদিকে জামায়াতের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, নির্বাচনকে পেছানোর কোনো দুরভিসন্ধি তাদের আছে কি না। ফলে এক দল সংস্কারকে ভেস্তে দিচ্ছে, আরেক দল নির্বাচনকে পেছানোর চেষ্টা করছে।’
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিএনপিসহ দলগুলো নির্বাচনমুখী তৎপরতাও শুরু করে। প্রার্থী বাছাই, জোটের মেরুকরণ, প্রচারণাসহ নানামুখী কার্যক্রম মাঠে গড়ায়। সরকারের পক্ষ থেকেও জোরেশোরে ভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আরপিও সংশোধনসহ বেশকিছু কাজ শেষ করেছে। নির্বাচন সংক্রান্ত অন্য কাজগুলোও এগিয়ে চলছে। কিন্তু এরপরও এখন ভোটের ব্যাপারে নতুন করে সন্দেহ-সংশয়ের কথা আসছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বড় দলগুলোর শীর্ষ রাজনীতিকদের অনেকেই এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সবার ধারণা ছিল, নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতসহ সংস্কার প্রস্তাবগুলো গণভোটে যাবে। কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন একটা বাজে কাজ করেছে। দেশে একটা সংকট চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংকট বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে এখান থেকে বেরোনোর উপায় বের করতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। দলগুলো একে অপরকে হুমকি দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। তাতে অন্ধকারের শক্তি সামনে চলে আসতে পারে।
শনিবার দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় সরকার এখনো পাশ করতে পারেনি। এ পরীক্ষায় সরকারের ফেল করার সুযোগ নেই। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকারকে দ্রুত যাবতীয় পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রকৃতপক্ষে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন