অর্থনীতির সর্বনাশ : দুর্নীতির পৌষ মাস

gbn

কয়েক দিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্পপতির আহাজারি শুনছিলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ী। তাঁর মরহুম পিতা যে শিল্প-সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সেগুলো তাঁরা কয়েক ভাই মিলে তিন দশক ধরে বেশ সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করে আসছিলেন। আমি উল্লিখিত শিল্পপতির মতো বড় ব্যবসায়ী না হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলাম।

তাঁরা শুধু আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়; বরং পেশাদারিত্ব এবং ব্যবসার গুণগত মান রক্ষায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের আইকন মনে করেন। তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্ধ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান ছাড়াও রাষ্ট্রের রাজস্ব, ব্যাংক, বীমা, পরিবহন এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক লাভের যে সম্পর্ক রয়েছে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

 

আমি ভদ্রলোককে এর আগে সর্বদা হাসিখুশি দেখেছি, নিত্যনতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তাঁর এবং তাঁর পরিবারের নেশা।

কিন্তু হাল আমলে সম্ভবত তাঁর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তিনি বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন এবং নিজের শিল্প-সাম্রাজ্যের চিন্তায় আহাজারি করছেন। তাঁর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস নেই—বিদ্যুৎ সরবরাহ অপ্রতুল। দেশি-বিদেশি লেনদেন, চলতি মূলধন সরবরাহ, প্রজেক্ট আধুনিকীকরণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি ও রপ্তানি খাতে পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি যে ব্যাংকিং সুবিধা ভোগ করছিলেন তা হাল আমলে শুধু মুখ থুবড়ে পড়েনি; বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

 

অর্থনীতির সর্বনাশ : দুর্নীতির পৌষ মাসব্যাংকগুলোর দেউলিয়াত্ব, সরকারি নীতিমালার অভাব, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আজব সব হুকুম আহকাম এবং নব্য দুর্নীতিবাজদের তাণ্ডবের কারণে অন্য সব সাধারণ প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিরা যে দিনরাত কিভাবে মরণকান্না করছেন তা উল্লিখিত শিল্পপতির বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের দেশের অতীতে টার্গেট করে খুঁজে খুঁজে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় বর্তমান জামানায় টার্গেট করে করে দেশের বড় বড় শিল্পপতিকে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’ তাঁর মতে, দেশের প্রতিকূল ব্যাবসায়িক পরিস্থিতির কারণে অনেক ব্যবসায়ীকে আগামীতে সম্মান রক্ষায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে।

আমি ভদ্রলোকের বক্তব্য ইউটিউবে শুনছিলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে তাঁর বক্তব্যটি রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে এবং লাখ লাখ দর্শক গোগ্রাসে দেখছে এবং হাজার হাজার মানুষ বিরূপ মন্তব্য করছে চলমান শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে। আমাদের দেশের মানুষের যে সাধারণ অভ্যাস এবং সামাজিক মাধ্যমের যে চরিত্র তাতে যৌনতা, খিস্তিখেউড়, গালাগালের ভিডিও যেমন অহরহ ভাইরাল হয়—তেমনি রাজনীতি, নাটক, সিনেমা এবং সেলিব্রিটিদের স্ক্যান্ডাল সমানতালে ভাইরাল হয়।

পরীমনি-হিরো আলম-রিয়ামনি, শেফুদা-ইল্লুবিল্লুর ভাইরাল সংস্কৃতিতে টেক্কা দিয়ে যখন একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর আহাজারি ভাইরাল হয়ে পড়ে তখন বুঝতে হবে ১৮ কোটি মানুষের পেটে টান পড়েছে—দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক মানুষকে অস্থির করে তুলেছে।

 

উল্লিখিত শিল্পপতির প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে কিছু বলি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আইএমএফ কেন হঠাৎ বেঁকে বসল তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা, আইডিবিসহ বিদেশি দাতা সংস্থা, এনজিওরা জাহাজ ভর্তি করে ডলার-পাউন্ড বাংলাদেশে পাঠাবে এমন স্বপ্ন যারা ফেরি করেছিল তাদের মুখে চুনকালি মেখে দাতা সংস্থাগুলো নতুন কোনো অর্থ ছাড় তো করছেই না—উল্টো পুরনো পাওনা নিয়ে সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে। বিদেশি বিনিয়োগ নেই আর দেশীয় বিনিয়োগ তো দূরের কথা—উল্টো শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠান-ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার কারণে ৩০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুন নাগাদ আরো ৩০ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে।

আমাদের দেশে একটি ভয়াবহ মন্দা (গ্রেট ডিপ্রেশন) যে কিভাবে ধেয়ে আসছে তা বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের চলতি বছরের জিডিপির হার সম্পর্কে অগ্রিম প্রতিবেদন দেখলেই অনুমান করা যাবে। গত এক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি নিয়ে দাতা সংস্থাগুলো মোট তিনবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথমবার বলেছিল—জিডিপি হতে পারে ৬% -এর কিছু বেশি। কয়েক মাস পর তারা বলে যে ৫%-এর সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। আর সাম্প্রতিক রিপোর্টে তা আরো ১% কমে গেছে। মাত্র এক বছরের মাথায় দাতা সংস্থার তিনটি রিপোর্টে আর্থিক লাভের যে ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠেছে তাতে জাতীয় দেউলিয়াত্ব, দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনীতির মহামারি অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতির দুরবস্থার মধ্যে অন্যান্য দেশে যা হয় তা আমাদের দেশেও হচ্ছে। প্রথমত, দুর্নীতি বেড়েছে এবং এই দুর্নীতি কতটা প্রকট তা একটি সরকারি প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে। যে দেশে গত এক বছরে কমবেশি ৩% জিডিপি কমে গেছে, সেখানে নতুন ছয় হাজার কোটিপতি পয়দা হয়েছে। সরকারি হিসেবে নতুন কোটিপতি যদি ছয় হাজার হয়, তবে বাস্তবে তা যে কয়েক গুণ বেশি সেটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এ অবস্থায় খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদের বাড়ি, গাড়ি, সোনা গহনার নিরাপত্তাসংকট আগামীতে প্রকট হয়ে পড়বে। কারণ চাঁদাবাজ-ঘুষখোররা নগদ টাকা না পেলে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ওপর হামলা শুরু করে দেবে।

আর্থিক সংকটের কারণে এরই মধ্যে প্রায় কোটি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে আরো এক কোটি লোকের বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। গ্রামের মানুষ শহরে এসেছে—আবার শহরের মানুষ গ্রাম-গঞ্জ-বনবাদাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ বাস্তুচ্যুত চাকরি হারিয়ে, কেউবা চাকরির খোঁজে ভিটামাটি ছেড়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের কারণেও বিরাট অর্থনৈতিক শূন্যতা দেখা দিয়েছে। দুই কোটি লোকের বাস্তুচ্যুতি, ত্রিশ লাখ লোকের বেকার হয়ে পড়া ও হাজার হাজার শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক মূল্য কত তা আমাদের কারোরই জানা নেই—তবে গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।

আমাদের মোট খেলাপি ঋণ, মোট আমানত, বিতরণকৃত ঋণ, সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ, জিডিপির ভয়ানক দুরবস্থা, জিএনপি অর্থাৎ—গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্টের অবস্থা এবং এত্তোসব দুর্বিপাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার, অবিচার, অনাচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সব সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কুশাসন এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কথা স্মরণ হলে যেকোনো মানুষের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ—কণ্ঠে আর্তচিৎকার এবং হিপণ্ড বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি যখন অনিবার্য ঠিক সেই সময় দুর্নীতিবাজদের উল্লাসনৃ

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন