জিবি নিউজ ডেস্ক ||
নৌকা প্রতীকে এমপি হয়েই এলাকা ছেড়েছেন, জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন,নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে 'সন্ত্রাসী ও মাস্তান' দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন *দলের পরিবর্তে এমপি লীগ,ভাই লীগ বানাতেই ব্যাস্ত তারা * স্বজন প্রীতি আর লুটপাটে সিদ্ধহস্ত।
দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়ানো ৭০ জন এমপি,মন্ত্রী কোনোভাবেই নৌকার কান্ডারি হতে পারছেন না। আগামি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব ভিআইপি ব্যক্তি যে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন না, তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। কারণ দলীয় হাইকম্যান্ড বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের বাদ দেওয়া এবং ক্লিন ইমেজ ও এলাকায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নৌকার প্রার্থী করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের জাতীয় কাউন্সিলের আগে দুই দফা এবং কাউন্সিলের পরে এক দফা মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ এখন শেখ হাসিনার টেবিলে জমা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত মন্ত্রী,এমপির তালিকা।
মন্ত্রী এমপিদের ব্যপারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টগুলোও এখন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেসব রিপোর্টে অতন্ত ১০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের অপর ৬০ জন এমপির নেতিবাচক কর্মকান্ডের চিত্রই ফুটে উঠেছে। গণভবন ও আওয়ামী লীগের একাদিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে,এবার তাদের নিশ্চিত কপাল পুড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, মামলা-হামলা করে হয়রানি, দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের কোণঠাসা করে 'এমপি লীগ,ভাই লীগ,বলয় সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। তারা এলাকা বিমুখ, জনবিচ্ছিন্ন নেতায় পরিনত হয়েছে। নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য, জলমহাল-বালুমহাল দখল,চাঁদাবাজি, লুটপাটের মাধ্যমে একেকজন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিনত হয়েছেন। অনেকেই এমপি নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে সন্ত্রাসী ও মাস্তান দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। কারও কারও বৌ,শ্যালক,ভাই,আত্মীয়স্বজন 'ছায়া এমপি' হয়ে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার নামে ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত থাকছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। ৯৬ এর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেের শেষদিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো দেখে বিস্মিত হয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। জানা গেছে ওমর ফারুক এর মা সরাসরি জামায়াত করতেন। রাজশাহীর এই ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে হয়েছেন এমপি,প্রতিমন্ত্রী, এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও। অথচ তিনি তার নির্বাচনি এলাকা গোদাগাড়ীতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করেছেন।
এরচেয়েও জনবিচ্ছিন্ন, দলবিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা সম্রাজ্য বানিয়ে বসপছেন হবিগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ। সাবেক মন্ত্রী মরহুম দেওয়ান ফকির গাজির সন্তান হিসেবে অনেকটা পৈতৃক সূত্রেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৈতরণী পার হন তিনি। কিন্তুু এরপর থেকেই এলাকা বিমূখ হয়ে ঢাকাতেই ঘাঁটি গেঢ়ে বসেন।রাজনীতির ময়দানে কোনরকম ইমেজ না থাকা এই সংসদ সদস্য দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিতেও বিরক্তবোধ করেন। এলাকার নেতা কর্মীরা তার দেখা পায় না বল্লেই চলে। জনবিচ্ছিন্ন ও এলাকা বিমুখ হলেও এমপি মিলাদ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি,আখরে গোছানোর লুটপাটে বেশ সিদ্ধহস্ত। এরইমধ্যে তিনি কুশিয়ারা নদীর তীর সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র জিম্মি করে তারই সহোদরদের দ্বারা আঙ্গুল ফুলে টাকার কুমির হয়েছেন মিলাদ। মাত্র কয়েকবছরের মধ্যেই অর্থবিত্তে জেলার অন্যতম ধনাঢ্যে পরিনত হয়েছেন তিনি। গাজী মিলাদ এমপি সবচেয়ে সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে। সেখানে নিজের বোন জামাইকে ভিসি নিযুক্ত করার পরই পরিবারের অন্তত ১৬ জনকে আসীন করেছেন সেখানে। টেন্ডার থেকে শুরু করে সব বাণিজ্যও হাতিয়েনিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই দলীয় পর্যবেক্ষণ টিমের তিন দফা গোপন অনুসন্ধানেই গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগের সিংহভাগ প্রমানিত হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের ১৪ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে দূর্নীতি দমন কমিশন। তদের মধ্যে রয়েছেন হাজী সেলিম,মোয়াজ্জেম হোসেন রতন,সামগুল হক চৌধুরী, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা প্রমূখ। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, দুদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব এমপির কাউকে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না৷ দলীয় মনোনয়ন পেতে তাদেরকে দুদক থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হবে।
আওয়ামীলীগ টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলীয় অনেক এমপির মধ্যে দেখা দিয়েছে গা ছাড়া ভাব। সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলেও তারা এলাকায় যায় না,খোঁজখবর নেন না এলাকার জনগণের। খোঁজখবর নেন না দলীয় নেতাকর্মীদের ও।তারা বেশিরভাগ সময় কাটান রাজধানী ঢাকায়।আবার কেউ কেউ সারা বছরই বিদেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান। অথবা থাকেন নিজস্ব ব্যবসায় বানিজ্য নিয়ে। এলাকার মানুষের সুখ দুঃখ দেখায় সময় নেই তাদের।একাদিক সূত্রে জানা গেছে আওয়ামী লীগের যেসব এমপি স্হায়ী নেতাকর্মী বা সাধারণ মানুষের খোঁজখবর কম নেন তাদের মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস (নাটোর-৪), মোতাহার হোসেন (লালমনিরহাট -১),এইচএন আশিকুর রহমান (রংপুর-৫),উম্মে কুলসুম স্মৃতি (গাইবান্ধা-৩),আয়েন উদ্দিন (রাজশাহী-৩),গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ (হবিগঞ্জ-১),নাসির উদ্দিন(যশোর-২),আনোয়ারোল আজীম (ঝিনাইদহ-৪),নেছার আহমদ (মৌলভীবাজার-৩),কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩),পঞ্চানন বিশ্বাস (খুলনা-১),মানু মজুমদার (নেত্রকোনা-১),মীর মোস্তাক আহমেদ রবি(সাতক্ষীরা-২),আফম রুহুল হক (সাতক্ষীরা-৩),ধীরেন্দ্র দেবনাত সঞ্জু (বরগুনা-১),তানভীর হাসান ছোট মনির (টঙ্গাইল-১),আতাউর রহমান খান (টাঙ্গাইল-৩),ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল (ময়মনসিংহ-১০),নাইমুর রহমান দুর্জয়(মানিকগঞ্জ-১), কাজী কেরামত আলী(রাজবাড়ী-১),ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন(কুমিল্লা-৩),আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী(চট্টগ্রাম-১৫),আশেক উল্লাহ রফিক (কক্সবাজার-২) সহ আরও কয়েকজন এমপি রয়েছেন যারা এলাকার সাথে যোগাযোগ কম রাখেন।
জাতীয় সংসদে কুমিল্লার (দেবিদ্বার)আসনের সংসদ সদস্য রাজী মুহাম্মদ ফখরুল ও দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বলে দলটির কেন্দ্রীয় একাদিন নেতা মনে করেন। এসব ঘিরে সৃষ্ট আলোচনা সমালোচনা য় গ্রহনযোগ্যতায় নাম উঠে এসেছে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রওশন আলী মাস্টারের নাম।তাকে সামনে নিয়েই নৌকা প্রীতিকের অগ্রজাত্রার স্বপ্ন দেখছেন তৃনমূল আওয়ামী লীগ। ফলে রাজী মোহাম্মদ ফখরুল আউট হচ্ছেন এতে কোন সন্দেহ নেই।কথায় কথায় মানুষের গায়ে হাত তুলাকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন তিনি। তার মারধর ও হামলা থেকে সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মচারী ও দলীও লোকজন রেহাই পাননি।
এমন ঘটনা ঘটেছে তাঁর সালিশ না মেনে আদালত মমলা করায় এক কাঠ ব্যবসায়িকে তুলে এনে মারধর করেছেন।অন্যের জমি দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তিনবারের এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। তিনি বরগুনা ২ (পাথরঘাটা, বামনা ও বেতাগী)আসনের সংসদ সদস্য হাচানুর রহমান।
২০১৩ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ গোলাম সবুর সরখ দূর্ঘটনায় মারা গেলে উপনির্বাচনে নৌকা প্রতীকে শওকত হাচানুর নির্বাচিত হন।২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ হন তিনি। তবে সাংসদ হাচানুর তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষ্য স্হানীয় ভাবে তাঁর দুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে, যাঁরা দলীয় মনোনয়ন চান। তাঁরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুদ্র বিষয়কে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন,যাতে তিনও দলীয় মনোনয়ন না পান।জমি দখলের কোন ঘটনা জানা নেই তাঁর বলেও দাবি করেন তিনি। সাংসদ হাচুনুর এর সালিস না মেনে পাওয়ানাদের বিরুদ্ধে মামাল করেন কাঠ ব্যবসায়ী জালাল হাওলাদার। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ২১ জুন পাথরগাটার সিনিওর জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদলত থেকে তাঁকে তুলে সংসদের কলেজ রোডে বাসভবনের কাছে নিয়ে মারধর করেন সংসদ ও তার লোকজন।এছাড়াও গত কয়েকবছরে নানারকম বিতর্কমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাচানুর রিমন দলীয় নেত্রীবৃন্দকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন।
জামালপুর ৪ আসনের ডাঃমুরাদ হাসান সহ অর্ধশতাধিক এমপির নেতিবাচক কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দলের ভিতরে বাইরে।এদের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ সভাপতির কাছে জমা হচ্ছে অভিযোগ স্তোপ।বেশিরভাগ এমপির বিরুদ্ধে দলে মাইম্যান তৈরি,নিজ এলাকায় একক অধিপত্য বিস্তার, অসধাচরণ,দখলবাজি,চাঁদাবাজি, দলীয় পদপদবী নিয়ে বানিজ্যসহ নানা অভিযোগ করা হয়েছে। আওয়ামীলীগের মনোনয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এবার গডফাদার ও জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব এমপির বিরুদ্ধে এলাকায় খুন, দূর্নীতি, মাদক ব্যবসায়,রৃণ খেলাপি, টেন্ডার-চাঁদাবাজি সহ দখলদারিত্বের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তারা কেউ মনোনয়ন পাবেন না।সূত্র জানায় তাদের আমল নামা যাচাই-বাছাই শেষে মনোনীতদের তালিকায় স্হান দিবেন হাইকমান্ড।বাকীদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন জুটছে না বলে আভাস দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন পার্টির নীতিনির্ধারকরা। দল ও সরকারের ইমেজ ক্ষুণকারীরা আছেন বাদ পড়ার তালিকায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের দ্বারা অব্যাহত রাখতে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে ৩য় বারের মতো মাঠ জরিপ এর কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মীর্জা আজম জানিয়েছেন,দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই এই মাঠ জরিপের কাজটি তদারকি করছেন।এই মাঠ জরিপের ওপর ভিত্তি করে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি চিন্তা করবেন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন