অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের অন্ধকার দিনগুলোতে জাতিসংঘ সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সংকট এবং ২০২৪ সালের অন্ধকার সময় পর্যন্ত জাতিসংঘ সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ সব মানুষের—ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা অবস্থান নির্বিশেষে অপরিহার্য অধিকার নিশ্চিত করতে যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটি বাংলাদেশের সংবিধানে গভীরভাবে প্রোথিত।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন আয়োজিত ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও তথ্য-উদ্ধার প্রতিবেদন’ শীর্ষ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান জাতির ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। ওই সময়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি নারী-পুরুষ—যাদের অধিকাংশই তরুণ—নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং দেশের সম্মান ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তাদের সাহস শুধু আমাদের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার পক্ষেই কথা বলেছিল।
প্রধান উপদেষ্টা ঐতিহাসিক মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের অবিচল সমর্থনের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সংকট এবং গত বছরের জুলাই ও আগস্টের অন্ধকার দিনগুলো পর্যন্ত জাতিসংঘ সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ মানবজাতির জন্য এমন কিছু অধিকার নির্ধারণ ও রক্ষা করার অঙ্গীকার করে, যা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে। ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ বিশ্বের জন্য একটি নৈতিক দিকনির্দেশনা হয়ে ওঠে এবং তার নীতিগুলো আমাদের সংবিধানেও দীর্ঘদিন ধরে সংযোজিত রয়েছে।
ড. ইউনূস আরও বলেন, গত ১৬ বছরে এ অধিকারগুলো নাগরিকদের থেকে বারবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দখল হয়ে গেছে। স্বাধীনতাগুলো হ্রাস পেয়েছে। শাসনের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল সহিংসতা। গত জুলাইয়ে আমাদের সমাজ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এ বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্টতা, সংকল্প ও অসম সাহসিকতার সঙ্গে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করেছিল।
তিনি জানান, গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই তিনি মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশনারের দপ্তরকে (ওএইচসিএইচআর) একটি স্বাধীন তথ্য-উদ্ধার মিশন পরিচালনার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেন—যার উদ্দেশ্য ছিল ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে সত্য প্রকাশ শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, বরং আরোগ্যের জন্যও জরুরি।
তিনি বলেন, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ হাই কমিশনারের প্রতিবেদনে দেখা যায়—মাত্র কয়েক সপ্তাহে আনুমানিক ১৪০০ মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে। প্রতিবেদনে এ সহিংসতাকে পরিকল্পিত, নির্দেশিত এবং আগের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সমন্বিতভাবে পরিচালিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে।
এ তথ্যগুলো আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যার মধ্যে বিবিসি ও আল-জাজিরার প্রতিবেদন রয়েছে।
জাতিসংঘের হাই কমিশনারের দপ্তরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তারা শুধু এই লঙ্ঘনগুলো নথিভুক্ত করেনি বরং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, সেজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এ সুপারিশগুলো হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছি—অন্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং নিজেদের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। সরকার গঠনের পর থেকে ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছি এবং গুম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছি।
তিনি বলেন, চলতি মাসের শুরুতে ওএইচসিএইচআর-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি, যার মাধ্যমে ঢাকায় একটি সহায়ক মিশন প্রতিষ্ঠিত হবে। এ মিশন সংস্কার কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও নাগরিক সমাজকে মানবাধিকারের মতো সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় সংরক্ষণের জন্য সক্ষম করে তুলবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রথম থেকেই জাতিসংঘ আমাদের রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল। তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে তার অবিচল সমর্থনের জন্য এবং গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক, ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিমের সদস্য, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গুইন লুইস এবং সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খানকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সংস্কারের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কাজ করছি। তবে ন্যায়বিচার মানে শুধু শাস্তি নয়—এটি এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা আর কখনোই নিজের জনগণকে দমন, নিস্তব্ধ বা ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত না হয়।
তিনি বলেন, আমরা একটি নবতর রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাই—যেখানে নির্বাচন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য। আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট; এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব বাংলাদেশি শান্তিতে, গৌরবে, স্বাধীনতায় এবং মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন