বৈষম্যমূলক ভ্যাট, আরো চাপে পড়বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত

gbn

দুর্ঘটনায় মা-বাবার মৃত্যুর পর কয়েকটি টিউশনি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অরুণিমা আহমেদ। নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপন করার জন্য অন্তত কিছুটা মানানসই জামাকাপড় ও প্রসাধনী কিনতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। ফলে খাবারের খরচে কাটছাঁট করতে বাধ্য হন তিনি। বেশির ভাগ দিন সকালে দোকান থেকে রুটি-বিস্কুট-কেক বা কলা খেয়ে টিউশনিতে যান।

কোনো কোনো দিন রাতেও ভারী খাবারের পরিবর্তে পাউরুটি-বিস্কুট-কেক বা ডিমের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেন। 

 

অরুণিমার মতো কেবল বহু শিক্ষার্থীই নয়, শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষও দিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরির একটি সস্তা উত্স হিসেবে রুটি, বিস্কুট ও কেকের ওপর নির্ভর করেন। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ‘গতানুগতিক’ বাজেটে এই খাদ্যপণ্যগুলোর ওপর বাড়তি মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বহাল রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে অরুণিমাদের মতো ছাত্রী ও মধ্যবিত্ত নারীদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় প্রসাধনী, বিশেষ করে আমদানীকৃত প্রসাধনীর ওপর উচ্চহারে শুল্ক ও ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে—যা রোলস-রয়েসের মতো গাড়ির ওপর আরোপ করা শুল্কের চেয়েও বেশি।

 

 

গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য, বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই করকাঠামো দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেবে।

ছাত্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে নিয়ে তরুণদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, এক হাজার ২২ জন উত্তরদাতার ৯৯ শতাংশই কোনো না কোনো সময় ভারী খাবার বাদ দিয়ে পাউরুটি, বিস্কুট কিংবা কেক খেতে বাধ্য হয়েছেন। উত্তরদাতাদের প্রায় ৬০ শতাংশ জানান, তাঁরা নিয়মিতভাবে সকালের নাশতা বাদ দেন। এই উত্তরদাতাদের ২৬ শতাংশই শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ প্রতিদিনের পুষ্টি ও ক্যালোরির জন্য নির্ভর করে কম খরচের এসব খাদ্যপণ্যের ওপর।

 

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘ফুড সিকিউরিটি আপডেট’ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ গত দুই বছর ধরে ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাল তালিকায়’ (রেড জোন) রয়েছে। এই শ্রেণিতে থাকা মানে দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উচ্চঝুঁকির সংকেত। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে এক বছরের গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০.৪৪ শতাংশে পৌঁছেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতির মধ্যেই নিত্য খাদ্যপণ্যে ভ্যাট বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির খাদ্য নিরাপত্তাকে সরাসরি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

এই সিদ্ধান্ত সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভারসাম্যহীনতার চিত্র তুলে ধরছে।

 

চলতি অর্থবছরের মাঝপথে এসে গত জানুয়ারিতে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় সরকার। ওই তালিকায় বেকারিপণ্য, বিস্কুট ও কেকও ছিল। এসব পণ্যে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এরপর সমালোচনার মুখে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ করা হয়। গত রমজানে নিত্যপণ্য বিবেচনায় নিয়ে এক মাসের জন্য করছাড় দেওয়া হলেও এসব পণ্যে ৭.৫ শতাংশ কর বহাল রাখা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, রমজানে যখন এই খাদ্যপণ্যগুলোকে ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ হিসেবে বিবেচনা করে ভ্যাটছাড় দেওয়া হয়, তখন বছরের বাকি সময়ে তা আবার কিভাবে ‘অপ্রয়োজনীয়’ পণ্য হয়ে পড়ে? 

বাজার পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে পাউরুটি, বিস্কুট ও কেকের প্যাকেটের আকার ছোট হয়ে আসছে। দাম অপরিবর্তিত থাকলেও পরিমাণ কমে যাওয়ায় গ্রাহক পাচ্ছেন কম খাদ্যমূল্য। এর ফলে একজন ভোক্তা প্রতি ইউনিট খাদ্যে আগের চেয়ে কম পুষ্টি ও ক্যালোরি পাচ্ছেন, যা খাদ্যপুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, যাঁরা এই সাশ্রয়ী খাবারেই দিনের একটি বা একাধিক বেলা পার করেন। অথচ সুপারশপগুলোতে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে, যেখানকার ক্রেতা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা।

বাংলাদেশ বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া যদিও দাবি করেছেন যে গত জানুয়ারিতে ভ্যাট বাড়ানোর পর পণ্যের পরিমাণ কমানো হয়নি, তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে ভ্যাট কমানো না হলে দাম বাড়ানো ছাড়া তাঁদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্কহারের তথ্য অনুযায়ী, একটি বিলাসবহুল বৈদ্যুতিক রোলস-রয়েস গাড়ির ওপর শুল্ক ৮৯.৩২ শতাংশ, অথচ আমদানীকৃত লিপস্টিকের মতো প্রসাধনপণ্যে তা দাঁড়িয়েছে ১৮৪ শতাংশ পর্যন্ত। ফেস ক্রিম ও স্কিন ক্রিমের ক্ষেত্রে শুল্ক ও করের সম্মিলিত হার ১৫৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের একাধিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘুরেফিরে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়িয়েছে। সরকার ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির পক্ষে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের যুক্তি দিচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নীতি কার্যত বৈষম্যমূলক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা সহযোগী প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করছেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কার্যকর কিছুই নেই এই বাজেটে। বরং তাদের খাদ্য খরচের ওপর আরো চাপ বাড়ানো হয়েছে।’ তাঁর মতে, খাদ্যপণ্যে ভ্যাট বসানো এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কমিয়ে দেওয়া—দুটি সিদ্ধান্তই গরিববিরোধী বার্তা বহন করে। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা এলেই নীতিনির্ধারকরা গরিবের পণ্যের দিকেই হাত বাড়ান। এটা দীর্ঘদিনের দৃষ্টিভঙ্গি, যা এখনো পরিবর্তন হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর। কিন্তু এর বোঝা পড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। এই কাঠামো ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত করনীতিতে ন্যায্যতা আসবে না।’ 

ভোক্তা অধিকার সংগঠনের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া জানান, বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভ্যাট আরোপের পর বিভিন্ন কম্পানি পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে অথবা দাম বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা দাম কমাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এতে গরিব মানুষের নিত্য খাবারে বাড়তি করের বোঝা পড়ছে।’ 

আমদানীকৃত প্রসাধনীতে উচ্চ ভ্যাট : মধ্যবিত্তের পকেটে আঘাত

‘লিপস্টিক ইফেক্ট’ তত্ত্ব অনুযায়ী, অর্থনৈতিক মন্দার সময় নারীরা দামি অলংকার বা পোশাকের বদলে কম দামে নিজেকে ভালো রাখার উপায় খোঁজে, যার প্রতিফলন প্রসাধনীর ব্যবহার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজ পণ্যের ওপর ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব এসেছে। এটি এমন এক বৈষম্য তৈরি করেছে যেখানে ফেস ওয়াশ, ক্রিম ও লিপস্টিকের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রসাধনীপণ্যের ওপর করের হার বিলাসবহুল রোলস-রয়েস গাড়ির (বৈদ্যুতিক) চেয়েও বেশি। ফেস ক্রিম ও স্কিন ক্রিমের ন্যূনতম মূল্য আট ডলার থেকে বেড়ে ২০ ডলার, অর্থাৎ ১৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। লিপস্টিকের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম মূল্য ২০ ডলার থেকে বেড়ে ৪০ ডলার হয়েছে, অর্থাত্ ১০০ শতাংশ বাড়ানো। ম্যানিকিউর-পেডিকিউর প্রডাক্ট, পাউডার, ফাউন্ডেশন ও মেকআপ কিটেও ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ কর বৃদ্ধির দেখা মিলেছে। অথচ রোলস-রয়েসের মতো বিলাসবহুল গাড়ির শুল্কহার মাত্র ৮৯.৩২ শতাংশ। 

অতিরিক্ত এই কর কর্মজীবী নারী থেকে শুরু করে গৃহিণী—সবাইকে নতুন এক বোঝার মুখে ফেলবে। এই করকাঠামো শুধু পকেটের ওপর নয়, নারীদের আত্মবিশ্বাস ও পেশাগত জীবনের ওপরও আঘাত হানতে পারে। নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপন করার ক্ষমতা একজন নারীর পেশাগত সম্ভাবনা ও মানসিক সুস্থতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

প্রসাধনী খাতে কর বৃদ্ধির পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘প্রসাধনীর ওপর উচ্চ শুল্ক একদিকে মধ্যবিত্ত নারীদের জীবনযাত্রায় চাপ ফেলবে, অন্যদিকে এটি অনিয়ন্ত্রিত বাজার, ভেজাল প্রসাধনী উত্পাদন ও চোরাচালানের আশঙ্কা বাড়াবে। তাতে সরকার বরং রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।’ তিনি বলেন, ‘করনীতি যখন লিপস্টিকে রোলস-রয়েসের চেয়ে বেশি কর বসায়, তখন তা নীতিগত ভারসাম্য হারায়।’

এই করকাঠামো সাধারণ মানুষের বিপক্ষে এবং ন্যায়বিচারবিরোধী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, বর্তমান ভ্যাটকাঠামো মূলত রিগ্রেসিভ করব্যবস্থার উদাহরণ—যেখানে গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বেশি পড়ে। এই কাঠামো ভেঙে দিয়ে প্রগ্রেসিভ, অর্থাৎ আয়ভিত্তিক করনীতি চালু না করলে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন