রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ সমগ্র বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, ব্যথিত মানুষের ধ্যানের ছবি ও পথহারা জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে বিশ্বনবীর আগমনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তাঁর যথাযথ মর্যাদা, গুণাগুণ ও সর্বোত্তম আদর্শের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে শেষ করতে পারেনি।বিশ্বমানবতার জন্য তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতিহায় নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালন আল্লাহ তাআলার জন্য।’ আর বিশ্বনবীর প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত (অনুগ্রহ) স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ সুতরাং বিশ্বনবীর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য লিখনি দিয়ে বা আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন অতুলণীয় আদর্শের অধিকারী।তাঁর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে গিয়ে অসংখ্য আশেকে রাসুল জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যতই মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, ততই মনে হয় যেন তিনি তাঁর চেয়েও বেশি বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাইতো কবি নজরুল বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে।’ তিনি আরও লিখেছেন, তোমার নামে এ কী নেশা হে প্রিয় হজরত! যত ডাকি যত কাদি মেটে না হাসরত।’বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনন্য মর্যাদা, সর্বোত্তম আদর্শ, চারিত্রিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তাইতো আল্লাহ তাআলা সুরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর।’অতিব দুঃখের বিষয় হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ তথা ইয়াহুদি, নাসারা ও খ্রিস্টানরা তাঁর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন না করে নিজেদেরকে বেশি জ্ঞানী ও উত্তম আদর্শের অধিকারী দাবি করে থাকেন। অথচ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বকালের সেরা শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিজে ঘোষণা দেন, ‘আমি মানুষের মাঝে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতেই প্রেরিত হয়েছি।’ আর এ জন্যই তিনি নিজেই সর্ব প্রথম সর্বোত্তম চরিত্র অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তার উত্তম চরিত্রের ঘোষণায় বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য তাঁর আদর্শের অনুসরণীয়, অনুকরণীয়, শিক্ষণীয় ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তাআলা সুরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, অবশ্যই তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’মানব দরদি ও দয়ালু হিসেবে আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে কেউই বিশ্বনবির সমকক্ষ ছিলেন না। এ দয়া ও মায়া বিশ্বনবিকে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বিচার থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যদিও তিনি দয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তথাপিও আল্লাহর বিধান লংঘনের বিচারে তিনি ছিলেন বজ্র-কঠোর, ইস্পাত-কঠিন হৃদয়ের অধিকারী।তিনি আমানতের খিয়ানত করতেন না। যদিও মক্কার অবিশ্বাসীরা বিশ্বনবির নবুয়ত ও রিসালাতকে স্বীকার করতো না ঠিকই কিন্তু তারা তাদের অমূল্য ধন-সম্পদ, স্বর্ণ-রৌপ্য ও অর্থ-মুদ্রা তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতে কখনো দ্বিধাবোধ করতো না।বিশ্বনবি ছিলেন শ্রেষ্ঠ দানবির। অকাতরে তিনি মানুষকে দান করতেন। এ জন্য হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সমস্ত অর্থ বিশ্বনবিকে খরচ করার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ তিনি দারিদ্র্যকে ভালোবাসতেন। তিনি চাকচিক্যপূর্ণ পোশাক পরিধান না করে তালিযুক্ত পোশাক পরলেও তা ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিযুক্ত।বিশ্বনবির ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। তিনি কখনো কারো সঙ্গে রাগ করতেন না। শিশুদেরকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে কৌতুক, খেলাধুলা করতেন। নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি ঘরের কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দশ বছর তাঁর খিদমতে ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে কখনো তিনি বিশ্বনবীকে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে রাগ করতে দেখেননি।তিনি ছিলেন শান্তির প্রিয় অনুকরণীয় আদর্শ। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কোনো যুদ্ধে আক্রমনাত্মক ছিলেন না বরং তিনি প্রতিরক্ষামূলক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি কোনো যুদ্ধে মুসলমানকে প্রথমে আক্রমন করতেও দেননি। এমনকি তিনি যে সকল যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, তাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি এমন শান্তিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেন যে, মুসলিম বাহিনী মক্কার প্রায় দ্বারপ্রান্তে আসার পরই মক্কার কাফিররা এ বিষয়ে অবহিত হয়।পৃথিবীর সবচেয়ে আল্লাহভীরু, জ্ঞানী ও রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার পরও তিনি ছিলেন সবার সঙ্গে মিশুক এবং বিনয়ী। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর জন্য কোনো রাজকীয় আসনের ব্যবস্থা ছিল না, ভ্রমণে, চলা-ফেরায় তিনি ছিলেন অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই। এমনকি খাবার গ্রহণেও তিনি মাটি বসতেন।আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তিনি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে দিনের বেলায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে, জিহাদের ময়দানে এবং রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দিতেন। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পড়তে তাঁর পা ফুলে যেত। মানুষকে আল্লাহর প্রতি ফিরে আসার জন্য তাওবার করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, নিশ্চয় আমি প্রতিদিন ১০০বার তাওবা করি।তিনি কপটতা, কুসংস্কার ও ভুল ধারনাকে পশ্রয় দিতেন না। তাঁর ছেলে মারা যাওয়ার পর সূর্য গ্রহণ হলে সবাই বলতে লাগলো যে, বিশ্বনবির ছেলের মৃত্যুতে প্রকৃতি শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্বনবি বললেন তাঁর ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে এর নূন্যতম সম্পর্কও নেই।বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় নীতিই ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ রাজনীতি। তিনি ছিলেন দুনিয়ার জীবনের সকল ক্ষেত্রে তথা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সাংস্কৃতিকনীতি, সমবায়নীতি, সমরনীতিসহ সকল কল্যাণকর নীতির বাস্তবায়নকারী। যার প্রমাণ বহন করে মহাগ্রন্থ আলকুরআন এবং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস।এ কারণেই তিনি তাঁর উম্মাহর প্রতি দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেন, ‘তোমরা যাতে বিভ্রান্ত না হও, সে জন্য আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি- একটি পবিত্র কুরআন ও অপরটি আমার হাদিস।’আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাঁর দিক-নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার এবং তাঁর আদর্শকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধারণ করে সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন। লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী ছাহেব।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন