মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ এক বছরের বেশি সময় ধরে। চলতি বছর দুই দফা বৈঠকেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দুই দেশ। শ্রমবাজার নতুন করে চালুর অন্যতম অন্তরায় ‘সিন্ডিকেট জটিলতা’।
দেশটিতে লাগাতার অবৈধ বাংলাদেশি গ্রেফতার, ভিজিট ভিসায় গিয়ে প্রতারণা, জঙ্গি তৎপরতা এবং সবশেষ গত বছর ভিসা থাকার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেতে না পারা সাত হাজার ৮৬৯ জন কর্মীর চাহিদাপত্র নিয়ে রয়েছে সংকট। এরই মধ্যে সোমবার (১১ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছেন। এ সফর ঘিরে সংকটময় শ্রমবাজারটিতে আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাত হাজার ৮৬৯ কর্মীর বিষয়ে যেন সময় বাড়ানো হয় এবং কনস্ট্রাকশন ও ট্যুরিজম ছাড়াও অন্য সেক্টরে কর্মী নেওয়া হয় সে বিষয়ে উপদেষ্টার সফরে আলোচনা হবে। হয়তো মালয়েশিয়া আরও পাঁচমাস সময় বাড়াতে পারে। এ বিষয়ে আমরা খুবই আশাবাদী।-উপসচিব হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কর্মসংস্থান-১ শাখা) মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মূল এজেন্ডা শ্রমবাজার খোলা। উপদেষ্টার সফরে সেটা জোর দিয়ে আলোচনাও হবে। তবে বাজার খোলার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। যেহেতু বাজার খোলার বিষয়টা নির্ভর করবে মালয়েশিয়ার ওপর, তাই নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
৭৮৬৯ কর্মীর কাজের চাহিদায় গুরুত্ব
গত বছরের ৩১ মে মালয়েশিয়া যেতে না পারা ১৮ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রথম ধাপে দেশটিতে প্রবেশের জন্য সাত হাজার ৮৬৯ জনকে যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত করেছে মালয়েশিয়া। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড-বোয়েসেলের মাধ্যমে কনস্ট্রাকশন ও ট্যুরিজম সেক্টরে দেশটিতে যেতে না পারা এসব কর্মীকে নেবে বলে জানিয়েছে দেশটি। এসব কর্মীকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠাতে হবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে নির্ধারিত এই সাত হাজার ৮৬৯ কর্মীর যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। যথাসময়ে চাহিদাপত্র পাওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠানো নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে।
মালয়েশিয়া এসব কর্মীদের প্রত্যেককে ট্রেনিং দিয়ে নেবে। এরই মধ্যে এই কর্মীদের জন্য ২৯টি ট্রেনিং সেন্টারও সিলেক্ট করা হয়েছে। সেখানে তারা কনস্ট্রাকশন সেক্টরের ওপর ১৫ দিনের ট্রেনিং করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তত থাকবেন। দেশটির কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে, শিগগির ডিমান্ড লেটার পাবো।- বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক শওকত আলী
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো থেকে চাহিদাপত্র পাওয়া জরুরি। কারণ বোয়েসেলের মাধ্যমে গেলে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীরা টাকা পাবে না। তারা হয়তো গড়িমসি করতে পারে। আবার ডিসেম্বরের মধ্যে যাওয়ার একটা সময় বেঁধে দিয়েছে। তাই এদের সবার যাওয়া নিয়েও বিলম্ব হতে পারে।’
আগে মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীর ব্যাপারে কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাত হাজার ৮৬৯ কর্মীর বিষয়ে যেন সময় বাড়ানো হয় এবং কনস্ট্রাকশন ও ট্যুরিজম ছাড়াও অন্য সেক্টরে কর্মী নেওয়া হয় সে বিষয়ে উপদেষ্টার সফরে আলোচনা হবে। হয়তো মালয়েশিয়া আরও পাঁচমাস সময় বাড়াতে পারে। এ বিষয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। কিন্তু সাত হাজার ৮৬৯ কর্মীর কথা তো তারা বলছে, সুতরাং আমরা সবাইকে পাঠাবো। আরও বেশি পাঠানোর চেষ্টা করবো।’
আমরা গত এক বছর ধরেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বলে আসছি। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে আমরাও আশা করছি বাজার খোলার একটা সুরাহা হতে পারে। সেটি যেন সিন্ডিকেটবিহীন হয়।- বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম
তিনি বলেন, ‘এই কর্মীগুলো পাঠানোর ব্যাপারে আপাতত কোনো শঙ্কা দেখছি না। কিছু এজেন্সি ধরনা দিচ্ছে। তারা যেতে না পারা কর্মীদের পাঠাতে চায়। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে তারা নানা গুজবও ছড়াচ্ছে।’
বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া এসব কর্মীদের প্রত্যেককে ট্রেনিং দিয়ে নেবে। এরই মধ্যে এই কর্মীদের জন্য ২৯টি ট্রেনিং সেন্টারও সিলেক্ট করা হয়েছে। সেখানে তারা কনস্ট্রাকশন সেক্টরের ওপর ১৫ দিনের ট্রেনিং করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তত থাকবেন। দেশটির কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে, শিগগির ডিমান্ড লেটার পাবো।
শ্রমবাজার খুললে বন্ধ হবে অবৈধ যাত্রা
গত বছরের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর থেকে অবৈধভাবে ভিজিট ভিসার নামে কাজের উদ্দেশ্যে দেশটিতে বহু বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে ৪২৬ জন বাংলাদেশি কর্মী ফেরত এসেছেন। এই ৪২৬ জন বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকেই ফেরত এসেছেন ৩৫৬ জন। আর এই সাত মাসের বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে সাজা ভোগ করে ফেরত এসেছেন ৭০ জন বাংলাদেশি।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অসাধু দালালরা শ্রমবাজার বন্ধ থাকলেও কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় লোক পাঠাচ্ছে। এরা গিয়ে কেউ গ্রেফতার হচ্ছে, কাউকে আবার এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ঋণ করে কিংবা কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। তাই মালয়েশিয়াসহ নতুন শ্রমবাজার খোলা এখন খুবই জরুরি। বৈধ পথে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলে মানুষ আর প্রতারণার শিকার হবে না।’
সিন্ডিকেটবিহীন শ্রমবাজার খোলার দাবি বায়রার
প্রধান উপদেষ্টার সফর ঘিরে সিন্ডিকেটবিহীন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার দাবি জানিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রা। গত ৭ আগস্ট প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর একটি চিঠিতে বায়রা বলেছে, ফ্যাসিবাদী আমলে সিন্ডিকেট মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা সংগ্রহ করে, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন থানায় মামলা চলমান। দুদক ও সিআইডির তদন্তাধীন। মালয়েশিয়া আরও ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নিলেও বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে সিন্ডিকেট প্রথা নেই। সুতরাং, বাংলাদেশ থেকেও যেন সিন্ডিকেট ছাড়া লোক নেওয়া হয়, সে দাবি জানাই।
বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গত এক বছর ধরেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বলে আসছি। সব এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিতে হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সংগঠিত হওয়া সিন্ডিকেটের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করে কম খরচে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে আমরাও আশা করছি বাজার খোলার একটা সুরাহা হতে পারে। সেটি যেন সিন্ডিকেটবিহীন হয়।’
প্রধান উপদেষ্টার এ সফর নিয়ে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা আশাবাদী যে অনেকগুলো বাধা দূর করতে পারবো। প্রথমত, সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি সফর হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে ভালো রসায়ন আছে, আমরা সেটি কাজে লাগাবো।
জানা যায়, ১২ আগস্ট (মঙ্গলবার) কুয়ালালামপুরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জটিলতা, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, রোহিঙ্গা সংকট, কৃষি, হালাল খাদ্য, সমুদ্র অর্থনীতি, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুই দেশের নানান বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
রোববার (১০ আগস্ট) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পাবলিক ডিপ্লোমেসি) শাহ আসিফ রহমান জানান, ১২ আগস্ট পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, গভীর সমুদ্রের সঠিক ব্যবহার, কৃষি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য জোরদারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মালয়েশিয়া ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা সমুদ্রের ৪০-৫০ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ আহরণ করি। অথচ সমুদ্রের সীমানা প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের সীমানার চেয়ে বেশি। এখানে প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব দিতে চাইছেন। এছাড়া প্রোটন হোল্ডিংসের সঙ্গে ইলেকট্রিক যানবাহন উৎপাদন সম্ভাবনা এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানি এক্সিয়াটার প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বৈঠকও সূচিতে রয়েছে।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গেও প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হতে পারে। সেখানে তারা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় জটিলতা নিরসনের বিষয়ে কথা বলবেন।
শফিকুল আলম বলেন, বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বেশ কয়েকটি বিজনেস কনফারেন্সে বক্তব্য রাখবেন। আমরা আশা করছি এ সফর সফল হবে। আমাদের দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় অনেকে পড়তে যায়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভালো চাকরি হয় না। এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা হবে।
মালয়েশিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা সন্দেহে আটক বাংলাদেশিদের বিষয়ে প্রেস সেক্রেটারি বলেন, দুই দেশের পুলিশের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে। এখন থেকে যে কোনো ধরনের তথ্য যাতে যাচাই-বাছাই করা যায় এবং দ্রুত তথ্য শেয়ার করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিষয়গুলো দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন