ট্রাম্পের হুমকি সত্ত্বেও যে কারণে রাশিয়াকে ছাড়তে পারছে না ভারত

gbn

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে জটিল কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিজ দেশকে নিরপেক্ষ হিসেবে তুলে ধরার এই কৌশল পশ্চিমা বিশ্বের বহু সরকারের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা এরই মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

 

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ট্রাম্প সেই ধৈর্য হারিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, মোদীকে এখন অবশ্যই একটি পক্ষ বেছে নিতে হবে। আর ট্রাম্পের এই দাবি আরও জোরালো হওয়ার কারণ ও সুযোগ হলো- রাশিয়া থেকে ভারতের সস্তায় তেল আমদানি।

এই পরিস্থিতি মোদী ও ট্রাম্প- এই দুই জাতীয়তাবাদী নেতাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যাদের মধ্যে অতীতে বেশ আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা গেছে।

 

আবার দিল্লি অসন্তুষ্ট হওয়ার আরেকটি বড় কারণ- কাশ্মীরের পহেলগাম হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুদ্ধবিরতি আনার কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজেই দাবি করেছেন। একইসঙ্গে, ভারতের রুশ তেল কেনার সিদ্ধান্ত ‘মস্কোর যুদ্ধযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে’ বলে ট্রাম্প যে অভিযোগ করছেন, সেটিও মেনে নেয়নি নয়াদিল্লি।

ট্রাম্পও পাল্টা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারা নিয়ে তিনি এরই মধ্যে রাজনৈতিক চাপের মুখে আছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে যা খুশি করুক, আমার কিছু যায় আসে না। তারা চাইলে একসঙ্গে নিজেদের মরা অর্থনীতিকে ডুবিয়ে দিক।

বুধবার (৬ আগস্ট) ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) থেকে কার্যকর হবে। একইসঙ্গে, চলতি মাসের শেষদিকে ভারতের ওপর আরেক দফা ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণাও দেন ট্রাম্প, যা মূলত রুশ তেল ও গ্যাস কেনার কারণে ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

এই দুটি শুল্ক একত্রে কার্যকর হলে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। যা কোনো দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত সবচেয়ে বেশি শুল্কের মধ্যে একটি।

সপ্তাহের শুরুতেই ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন, রাশিয়ার পক্ষ নেওয়ার মাধ্যমে ভারত ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে সহায়তা করছে। নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ভারত শুধু বিপুল পরিমাণে রুশ তেলই কিনছে না বরং সেই তেলের বড় অংশ আবার খোলা বাজারে বিক্রি করে মোটা মুনাফাও অর্জন করছে। রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্র ইউক্রেনে কতজন মানুষ হত্যা করছে, তাতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

তবে মোদীর জন্য এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই সহজ নয় বরং ব্যাপক জটিল, কারণ রাশিয়া ছাড়া জ্বালানির কোনো সহজলভ্য উৎস তার কাছে নেই। এ কারণেই অন্যান্য দেশ যখন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে, তখন ভারত দৃঢ়ভাবে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তারা ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘অন্যায্য’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ভারতের যুক্তি- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজেরাও রাশিয়ার সঙ্গে এখনো সার ও রাসায়নিক পণ্যের মতো অন্যান্য খাতে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

 

রুশ তেলের বিকল্প নেই ভারতের

ভারতের বিশাল জনসংখ্যা ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে সচল রাখতে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভর করে আসছে। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটিরও বেশি এবং দেশটি এরই মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল ভোক্তা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রয়টার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই চীনকেও পেছনে ফেলবে ভারত।

ট্রেড ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠান কেপলারের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশ্লেষক মুইউ শু’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারতের তেল আমদানির ৩৬ শতাংশই এসেছে রাশিয়া থেকে, যার ফলে মস্কো এখন ভারতের সর্ববৃহৎ তেল সরবরাহকারী।

 

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক অমিতাভ সিংহ বলেন, রাশিয়া ভারতকে তেল দিচ্ছে বড় ধরনের ছাড়ে, যা অন্য কোনো সরবরাহকারী দিত না। এই কেনাকাটা পুরোপুরি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত।

২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর ইউরোপ রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে দেয়। ফলে রুশ তেলের প্রধান বাজার হয়ে ওঠে এশিয়া- বিশেষত চীন, ভারত ও তুরস্ক। এই তেল বিক্রিই এখন মস্কোর অন্যতম প্রধান রাজস্ব উৎস।

ভারত যদিও ধীরে ধীরে তেলের উৎসে বৈচিত্র্য এনেছে, একেবারে রুশ তেল আমদানি বন্ধ করা মানে বিশাল ঘাটতির মুখে পড়া। বর্তমানে দেশটি তার মোট তেল প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ আমদানি করে ও তাদের নিজস্ব উৎপাদন এই ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়।

 

পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের সদস্য দেশগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও একদিনে অতিরিক্ত ৩৪ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মুইউ শু।

আরও একটি জটিলতা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র নিজের পক্ষ থেকে ভারতকে অন্য কিছু বাজার থেকেও তেল কিনতে দেয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন ইরান ও ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারতসহ অন্যান্য দেশকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, যাতে এসব দেশ থেকে তেল না কেনা হয়। অথচ একসময় ভারত ছিল ইরানের অন্যতম বৃহৎ তেল ক্রেতা। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি থেকে ভারত প্রতিদিন ৪ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত তেল কিনত।

অধ্যাপক অমিতাভ সিংহ বলেন, আমাদের হাত পেছন থেকে বাঁধা। ভারতের তেল বাজারের চলাচলের জায়গা এখন খুবই সীমিত।

 

তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের চাপের মুখেও দিল্লি আপাতত নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার পথ খোলা রেখেই ভারত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক তেল আমদানির প্রচলিত রুট অনুসন্ধান করবে। তবে রুশ তেল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে সময় লাগবে ও তা রাতারাতি সম্ভব নয়।

রাশিয়া-ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধু তেল বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এই সম্পর্ক কয়েক দশক পুরনো ও বহুমাত্রিক। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও, ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে, তখন ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই সময় থেকেই রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা বেড়েছে নয়াদিল্লির। তবু আজও রাশিয়াই ভারতের সর্ববৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী বলে তথ্য দিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)।

২০২৪ সালে মোদীর মস্কো সফরে পুতিন তাকে জড়িয়ে ধরেন ও নিজ গাড়িতে করে শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ান, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালোই আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি করে।

এদিকে, ট্রাম্প ও মোদী অতীতে একাধিকবার তাদের ‘ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব’র বিষয়টি জোর দিয়ে তুলে ধরেছেন। ২০১৯ সালের এক র‍্যালিতে ট্রাম্প বলেছিলেন, ভারতের ইতিহাসে এর চেয়ে ভালো বন্ধু আর কোনো প্রেসিডেন্ট ছিল না।

জেএনইউ’র অধ্যাপক অমিতাভ সিংহ বলেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে ফিরে এলে এই বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই সম্পর্ক খারাপের দিকে গেছে।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন