হুসনা খান হাসি ||
একটি প্রশিক্ষণ বিমান। উদ্দেশ্য ছিল কেবল আকাশে ওড়ার অভ্যাস অর্জন। কেউ কি ভেবেছিল, সেই নিরীহ উড়াল এক সময় হঠাৎ ছুটে পড়বে শহরের শান্ত বিকেলে, যেখানে শিশুরা খেলা শেষে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল?
ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ প্রাঙ্গণে বিকেলের শেষভাগে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা ছিল না শুধু একটি যান্ত্রিক ব্যর্থতা। এটি রূপ নেয় এক হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডিতে, যা মানুষের মননে রেখে যায় এক গভীর ক্ষত। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ, ছিন্ন খাতা আর ভাঙা কাঁচের চেয়েও বেশি আঘাত করেছে মানুষের ভেতরে। সেই যন্ত্রণা নিঃশব্দ হলেও চাপা কষ্টে প্রতিটি হৃদয় ভারী হয়ে উঠেছে।
বিমানটি আছড়ে পড়েছিল একটি স্কুলের ছাদে। ক্লাস সদ্য শেষ হয়েছিল। শিশুরা কেউ মাঠে খেলছিল, কেউ ব্যাগ গুছাচ্ছিল, কেউ বা বন্ধুর সঙ্গে টিফিন ভাগ করছিল। মুহূর্তেই সেই চেনা বিকেল ভেঙে পড়ে। বিকট শব্দ, আগুনের ঝলকানি, হাহাকার, আর আতঙ্কে ছেঁয়ে যায় চারপাশ। নিরাপদ আশ্রয় বলে যাকে ভাবা হয়েছিল, তা মুহূর্তেই পরিণত হয় এক ভয়ংকর স্মৃতির কেন্দ্রে।
মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন ২০টি শিশুর প্রাণ। আগুনের ভয়াবহতা সত্ত্বেও একে একে শিশুদের নিরাপদে সরিয়ে আনেন তিনি। শরীর পুড়ে গেলেও তাঁর মানসিক শক্তি অটুট ছিল। ভয় না পেয়ে, নিজের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে, তিনি শুধু একটিই লক্ষ্য নিয়েছিলেন - শিশুদের বাঁচানো।
তাঁর এই নিঃস্বার্থ সাহস ও ভালোবাসা তাঁকে মানবতার প্রতীক করে তুলেছে। মুখে যন্ত্রণার কথা না বলেও, আগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয় ও আশার এক আলোকবর্তিকা।
মাহরিন চৌধুরীর এই আত্মত্যাগ শুধু ইতিহাসের নয়, হাজারো হৃদয়ের গভীরে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তিনি কেবল একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন মানবতার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কত সহজেই পালটে যেতে পারে সবকিছু। একটি ছোট যান্ত্রিক ত্রুটি, একটি ভুল হিসাব, কিংবা সামান্য প্রশিক্ষণগত অসতর্কতা মুহূর্তেই ডেকে আনতে পারে এমন অপূরণীয় বিপর্যয়। তদন্ত হবে, প্রশ্ন উঠবে, দায় নির্ধারণ হবে। কিন্তু যে আগুন মানুষের ভেতরে জ্বলে উঠেছে, তার ক্ষতি কোনো রিপোর্টে ধরা যাবে না।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি কতগুলো অমূল্য প্রাণ। এই শোক শহরের অলিগলি পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যে আকাশে স্বপ্ন নিয়ে উড়তে চেয়েছিল কিছু তরুণ মন, সেই আকাশেই থেমে গেল তাদের যাত্রা। এই ঘটনা আর শুধু সংবাদ নয়, এটি এক গভীর বেদনা, যা অগণিত হৃদয়ের অংশ হয়ে গেছে।
এতো অল্প বয়সে নিভে গেল কত সম্ভাবনা, থেমে গেল অজস্র স্বপ্নের পথচলা। প্রতিটি প্রাণ ছিল একটি পরিবারের আদরের ধন, সমাজের ভবিষ্যৎ, দেশের গর্ব।
শহর আজ নিস্তব্ধ, বাতাস ভারী, আকাশ হয়তো আজ কাঁদছে তাদের জন্য, যারা আর কখনো ফিরবে না। তাদের স্মরণে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধায়, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে একটি দায়বদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে। যেন এই ধরনের প্রাণহানি আর না ঘটে।
তদন্ত চলবে, দায় নির্ধারিত হবে, রিপোর্ট লেখা হবে। কিন্তু যে মা আর অপেক্ষা করবে না, যে শিশু আর মাঠে ফিরবে না, তাদের ব্যথা কোনো পরিসংখ্যানে ধরা সম্ভব নয়।
নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আহতদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য রইল আন্তরিক প্রার্থনা। আর যাঁরা হারিয়েছেন আপনজন, তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর সহানুভূতি ও ভালোবাসা।
এই শোকের মুহূর্তে আমরা বলি - ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তবে এই দুর্ঘটনা আমাদের কেবল কাঁদায় না, প্রশ্নও তোলে, প্রশিক্ষণের মান, নিরাপত্তার ঘাটতি, পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজ ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে।
এই প্রশ্নগুলো কেবল তদন্তের জন্য নয়, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন