আল-হামদুলিল্লাহ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য । আমি আজকের খুতবায় এমন একটি বিষয়ে কথা বলতে চাই যা আমাদের অনেকের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তা হচ্ছে- দৈনন্দিন জীবনে কুরআনের সাথে সংযুক্ত থাকা । শুধু পর্যবেক্ষনে নয়, বাস্তব জীবনে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়। পয়লা আগস্ট শুক্রবার ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা উপস্থাপন করছিলেন শায়খ রাশিদ খান। তিনি বলেন, চলুন আমাদের ইতিহাস থেকে একটি চিত্র দিয়ে শুরু করি। এক সময় ছিল, যখন মুসলমানরা কা'বায় নামাজ পড়তে পারতেন না। আবু বকর (রা.) তাদের একজন ছিলেন। তিনি তখন নিজের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাঁর কণ্ঠ কম্পিত হতো। তিনি কাঁদতেন। আর আশেপাশের মানুষ—নারী, শিশু, এমনকি অবিশ্বাসীরাও—জড়ো হয়ে যেতেন। তারা যে কুরআন শুনত, তাতে বিমোহিত হয়ে পড়ত। কুরআন তখন জীবন্ত ছিল। এটা শুধু একটি বই ছিল না, এটা ছিল একটি উপস্থিতি। যারা তিলাওয়াত করত, তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতো।
এমনকি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর হৃদয়কে দৃঢ় রাখতে কুরআনের প্রয়োজন বোধ করতেন। আল্লাহ বলেন: আর আমরা একে (কুরআনকে) পর্ব পর্ব করে অবতীর্ণ করেছি যেন আমরা এর দ্বারা তোমার হৃদয়কে দৃঢ় রাখি। (সুরা আল-ফুরকান, ২৫:৩২)
কেন ধাপে ধাপে? কারণ জীবন একসাথে কাটে না। জীবন কেটে যায় দিন দিন করে। এবং যেমন প্রতিদিন আমাদের হৃদয় কলুষিত হয়—বিভ্রান্তি, পাপ, ও চাপ দ্বারা—তেমনি কুরআন প্রতিদিন আমাদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ ও পুনরুজ্জীবিত করে।
নবী (সাঃ) এবং সাহাবারা কোনো নিখুঁত পরিবেশে বাস করতেন না। তারা অবিশ্বাস, দুর্নীতি ও প্রলোভনের সম্মুখীন হতেন—ঠিক আমাদের মতো। তারা দিনের শুরু করতেন কুরআন দিয়ে—আলো নিয়ে । কিন্তু তারা জানতেন, বাইরে পা রাখলেই সেই আলো পরীক্ষা হবে, কলুষিত হবে। তাই তারা আবার ফিরে আসতেন কুরআনের কাছে। ওটাই ছিল তাদের প্রতিদিনের অবলম্বন। আমরাও সেটাকেই অবলম্বন বানাতে পারি, বানানো উচিত। অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন: আমার তাজবীদ নেই”, “আমি ভালো পড়তে পারি না”, “আমার কণ্ঠ সুন্দর না।” কিন্তু নবী (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং এতে কষ্ট পায়, জড়িয়ে পড়ে. তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার। একটি পুরস্কার পড়ার জন্য। আরেকটি সংগ্রামের জন্য। আপনার সংগ্রামই ইবাদত। সেটা উচ্চারণ হোক বা সময় বের করা হোক, আপনার প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে মূল কথা হলো: পরিপূর্ণতা নয়, ধারাবাহিকতা চাই। প্রতিদিন একটি আয়াত হলেও চলবে ।কত সময় পড়বেন? এক একদিন এক এক রকম হলেও চলবে। পড়া সুন্দর না হলেও চলবে । কুরআন পারফরম্যান্সের জন্য নয়। এটি সংযোগের জন্য।
নবী (সাঃ) আরও বলেন, কুরআন হৃদয় থেকে এত দ্রুত সরে যায়, যেমন উট দড়ি ছিঁড়ে পালায়। যদি আমরা নিয়মিত না থাকি, এটি আমাদের ছেড়ে যায়। এবং আমরা অনেকেই একটি ফাঁদে পড়ি। ভাবি, “পুরোপুরি না পারলে কিছুই না।” আর সেই জন্য কিছুই করি না। কিন্তু আল্লাহ চেষ্টা গ্রহণ করেন। মূল কথা হচ্ছে, আমরা যেন মুখ ফিরিয়ে না নেই।
বিশেষ করে এই ছুটির মাসগুলোতে, যখন স্কুল বন্ধ, পরিবার একসাথে সময় কাটায়, তখন আমাদের অভ্যাসগুলোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করতে হয় । অবসর থাকা কোনো সমস্যা নয় । কিন্তু যখন আনন্দ আমাদের আনন্দদাতাকে ভুলিয়ে দেয়, তখন সেটাই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেন, তারা যখন তাদেরকে যা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা ভুলে গেল, তখন আমরা তাদের জন্য সব কিছুর দরজা খুলে দিলাম—যতক্ষণ না তারা আনন্দে ডুবে গেল, তখনই আমরা হঠাৎ তাদের পাকড়াও করলাম…”। (সুরা আল-আন‘আম, ৬:৪৪) ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, কখনো কখনো আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতগুলোই আমাদের আল্লাহ থেকে আড়াল করে দেয় । তাই আনন্দ করো, কিন্তু সচেতন থেকো।
একটি কাজ ইবাদত হয় কি না, তা নির্ভর করে শুধু কাজটির ওপর নয়—বরং আপনি আল্লাহকে স্মরণ করছেন কি না, তার ওপর। দুইজন মানুষ একই জায়গায় যায়, একই খাবার খায়—কিন্তু একজনই পুরস্কৃত হন। যিনি আল্লাহকে স্মরণ করে থাকেন। সেই সচেতনতা সাধারণ জিনিসকেও ইবাদতে পরিণত করে।
এটা আমাদের পরিবারকেও শেখানো উচিত । আমরা যখন স্কুল ট্রিপ, খেলা, ঘোরাফেরার সময় বের করি কিন্তু মসজিদ, কুরআন ক্লাস বা হালাকার জন্য সময় দিতে কুণ্ঠাবোধ করি, তখন আমরা একটি বার্তা পাঠাই—দীন আলাদা কিছু, ঈমান বোঝা, কুরআন শুধু একটি নির্দিষ্ট বাক্সে রাখা বিষয়।
আমরা আরাম খুঁজি অন্যখানে । কিন্তু নবী (সাঃ) বলতেন: “হে বেলাল, নামাজের মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও"। তাঁর আরামের উৎস ছিল সালাত। তাঁর আনন্দ ছিল কুরআন। আমরাও সেইটুকু গ্রহণ করতে পারি।
চলুন বাস্তব হই । সব পরিবারের নিখুঁত রুটিন নেই । সব মানুষের সময় একরকম নয়। কিন্তু আপনার দিন পাল্টালেও, হাল ছাড়বেন না। একটি আয়াত। একটি স্মরণ। একটি আন্তরিক চেষ্টা—সবই গন্য।
আর যদি মনে হয় আপনি অনেক দূরে, ভেঙে পড়েছেন, অনেক পিছিয়ে—তাহলে এই হাদীসটি মনে রাখুন: “যে ব্যক্তি ভালো কিছু করার নিয়ত করে কিন্তু করতে পারে না—আল্লাহ তাঁর জন্য সম্পূর্ণ সওয়াব লিখে দেন।” তাই আপনি শুধু চিন্তা করলেই, সে চিন্তাও ইবাদত।
আপনার দিনটিকে কুরআনের সঙ্গে যুক্ত করুন।আপনার ঘরে। গাড়িতে। বিরতির সময়ে। নেক্সট স্ক্রলের বদলে এটা বেছে নিন। নেটফ্লিক্সের পর্বের বদলে কুরআন চালান। এটাকে এমন কিছুতে রূপান্তর করেন, যেটা আপনার সন্তানদের আনন্দের অংশ হিসেবে মনে থাকবে—আলাদা কিছু নয়। হে আল্লাহ, কুরআনকে আমাদের হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে দাও, আমাদের বক্ষের আলো বানিয়ে দাও, আমাদের দুঃখ দূরকারী এবং চিন্তার মুক্তি বানিয়ে দাও। আমাদেরকে কুরআন অনুযায়ী জীবনযাপন করাও, তাতে মৃত্যুবরণ করাও, এবং কুরআনের সাথীদের সঙ্গেই আমাদের পুনরুত্থিত করো। আমীন।
শায়খ রাশিদ খান : অতিথি খাতিব ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। পয়লা আগস্ট ২০২৫

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন