ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : হিজরী বছরকে যেভাবে অর্থবহ করে তোলা যায়

gbn

শাইখ আব্দুল কাইয়ুম ||

হিজরী একটি বছর পার হয়ে গেল। সময় যেন দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আমি সেই হাদীসটির কথা মনে করি, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের সময় আসবে না যতক্ষণ না সময় সংকুচিত হয়ে যায়। তখন এক বছর মনে হবে এক মাসের মতো, এক মাস মনে হবে এক সপ্তাহ, এক সপ্তাহ মনে হবে এক দিন, আর এক দিন মনে হবে যেন এক ঘণ্টা। এখন ঠিক সেরকমই লাগছে।

এটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে—আমরা কীভাবে বয়স ও বার্ধক্য নিয়ে কথা বলি। মানুষ গর্ব করে বলে, “আমি ৭০ বা ৮০ বছর পেরিয়ে গেছি।” কিন্তু আমি যখন শুনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার এক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেন তার দিনের অবস্থা কেমন, তখন তিনি বলেছিলেন—মূলত, “প্রতিটি দিন আমি আমার শেষ সময়ের এক ধাপ কাছে পৌঁছাই”—তখন সেটা আমার হৃদয়ে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। আমরা সাধারণত এভাবে ভাবি না। জন্মদিন বা কোনো অর্জনকে আমরা সফলতা হিসেবে দেখি, কিন্তু ভুলে যাই, প্রতিটি অতিবাহিত বছর আমাদের এই পৃথিবীতে সময়ের শেষ প্রান্তে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

সত্য হলো—আমাদের জীবন গঠিত প্রতিটি দিন দিয়ে । আর প্রতিটি দিন অতিবাহিত মানে আমাদের একটি অংশ চলে যাচ্ছে—যেটা আর কখনো ফিরে আসবে না। এটা হয়তো হাত বা পা হারানোর মতো দৃশ্যমান ক্ষতি নয়, কিন্তু এটি ক্ষতি বটে । সময় থামে না। সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না। আমরা নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিকে।

তবুও দীর্ঘ জীবন একটি আশার উৎস হতে পারে—যদি তা ভালো কাজে ভরা থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “সেরা মানুষ সেই, যার জীবন দীর্ঘ এবং আমল উত্তম।”

আমাদের কাউকেই উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করা হয়নি । আমাদের সকলকেই আমাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে । আমরা একদিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হব, আর সেই দিনে কিছুই গোপন থাকবে না। সবকিছু প্রকাশ পাবে । সেটা চিন্তা করলে ভয় লাগতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রহমত কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি। তাঁর রহমত সবকিছু ঢেকে দেয়।

সূরা আরাফ ১৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমার রহমত সমস্ত কিছুকে পরিবেষ্টন করেছে।” আর কেউ যদি সেই রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে সত্যিই সবকিছু হারিয়েছে।

এখন আমরা মুহাররম মাস অতিবাহিত করছি, যা হলো আরবী চারটি পবিত্র মাসের একটি। এই সময়ে ভালো কাজের প্রতিদান বেশি, আবার পাপও বেশি গুরুতর হয়। আলেমগণ বলেছেন, এই পবিত্র সময়ে গোনাহ করা আরও বড় অপরাধ। এটা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত—বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, যখন দৃষ্টিকে সংযত রাখা কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কঠিন হয়। কিন্তু তখনই আরও বেশি সচেতন থাকা দরকার। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের এই মাসে রোজা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন, বিশেষ করে ১০ই মুহাররম, ‘আশুরা’ দিনে । যখন তাঁকে এই দিনের রোজার সওয়াব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন: “এটি পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহর কাফফারা।” এছাড়াও ৯ই মুহাররম, অর্থাৎ ‘আশুরা দিনেও রোজা রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মৃত্যুর আগের বছরে বলেছিলেন, “আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে ৯ তারিখেও রোজা রাখব।” এই বছর ৯ই মুহাররম শুক্রবার পড়েছে । সাধারণত শুধু শুক্রবারে একা রোজা রাখা নিরুৎসাহিত করা হয়, যদি না তা অন্য দিনের সাথে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু আশুরার বিশেষ হাদীস থাকার কারণে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা যায়। তাই এই শুক্রবারে রোজা রাখলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে শুধু রোজা রাখাই যথেষ্ট নয়। এই পুরো মাস একটি সুযোগ—আরও বেশি দোআ করার, কুরআন পাঠ করার, আত্ম-পর্যালোচনার। এবং ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হলো গোনাহ থেকে বিরত থাকা। এমনকি দৃষ্টিকে সংযত রাখার মতো ছোট কাজও এই পবিত্র দিনগুলোতে বড় অর্থ বহন করে। যখন আমি গত বছরের কথা ভাবি, তখন নিজেকে প্রশ্ন করি: “আমি এই সময়টা কীভাবে কাটালাম?” আর আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: “এই বছর আমি কী পরিবর্তন করব?” আমরা কেউই জানি না, আমাদের আর কত বছর আছে। কিন্তু এটুকু জানি, এই মুহূর্তটা আমাদের হাতে আছে। হে আল্লাহ, আমাদের সময়কে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে সাহায্য করুন। আমাদের বাকি বছরগুলোতে ভালো কাজ করার তাওফিক দিন। অতীতের ভুলগুলো ক্ষমা করে দিন, আর আগামীর জন্য আমাদের শক্তি দিন।

জুমার খুতবা। ইস্ট লন্ডন মসজিদ। ২৭ জুন ২০২৫। শায়খ আব্দুল কাইয়ুম : ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন