‘মৌসুম’ যেমনই হোক, অতীতকে সরিয়ে রেখে আপাতত ‘দ্বিপাক্ষিক অংশীদ্বারত্বের’ ওপরেই জোর দিতে চায় দিল্লি আর মালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজের বিবৃতিতে সেই প্রতিফলনই মিলেছে।
মোদীর মালদ্বীপ সফরকালে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান গবেষণার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূচনা হয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাও।
যৌথ বিবৃতির সময় দুই দেশকে একে অপরের ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ উল্লেখ করে ‘গভীর সম্পর্কের’ কথা বলতে শোনা গেছে দুই রাষ্ট্রনেতাকেই।
মোদী বলেছেন, ভারত মালদ্বীপের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের ‘নেইবার ফার্স্ট’ নীতি এবং মহাসাগর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দুই বিষয়েই মালদ্বীপের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। মালদ্বীপের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারত গর্ববোধ করে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা মহামারি, ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের পাশে ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে থেকেছে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট মুইজ বলেছেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত অংশীদার। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা ও বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বাইরেও বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিস্তৃত, যা আমাদের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে।
প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিকে সামনে রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন মুইজ। তার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন দেখা গেছে, যার আঁচ পড়েছিল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও।
তবে মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো এবং দুই দেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে অংশীদারত্বের ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে–– পরিস্থিতি বদলেছে।
যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে
প্রেসিডেন্ট মুইজ জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় দুই দেশই।
ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটি সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ এবং তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
মালদ্বীপকে ভারতীয় মূল্যে ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) সম্প্রসারণ করার কথা ঘোষণা হয়েছে।
মুইজ বলেছেন, ওই এলওসি প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং হাউজিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবহার করা হবে। ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতও হয়েছে।
পাশাপাশি, ভারত সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এলওসির ক্ষেত্রে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা কমানো হয়েছে।
ভারত-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আইএমএফটিএ) আলোচনার সূচনা হয়েছে। মালদ্বীপকে ৭২টি হেভি ভেহিকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে, মালেতে প্রতিরক্ষা ভবন এবং অবকাঠামোগত স্থাপনার উদ্বোধনও করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট মুইজ ক্ষমতায় আসার পরপরই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখেনি দিল্লি।
সম্পর্কের টানাপোড়েন
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ৬০ বছরের। এই সময়কালে বিভিন্ন সময় ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণই থেকেছে।
মুইজ অন্য পথে হাঁটলেও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টরা ক্ষমতায় এসে প্রথম ভারত সফর করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতিই মেনে এসেছিলেন। একই মনোভাব দেখা গেছে অতীতেও।
নরেন্দ্র মোদীর সফর নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট সোলিহ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফর এটাই দর্শায় যে রাজনৈতিক উসকানি সত্ত্বেও ভারতের মধ্যে এমন একজন বন্ধুকে মালদ্বীপ পেয়েছে, যে বিশ্বস্ত এবং সময় তার প্রমাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তবে ইব্রাহিম সোলিহর পূর্বসূরি আবদুল্লা ইয়ামিন ভারতের বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। সেই পথই অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল মুইজকে।
প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছিল। ওই লেনদেন ২০২২ সালে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ায় এবং ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভারত মূলত মালদ্বীপে ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, সিমেন্ট, কৃষি পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রী রপ্তানি করে। মালদ্বীপ থেকে স্ক্র্যাপ ধাতু আমদানি করে ভারত।
তাছাড়া বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পর্যটক সে দেশে ভ্রমণে যান। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয় প্রেসিডেন্ট মুইজ ক্ষমতায় আসার পর।
দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সুর কাটতে শুরু করেছিল তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই। ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির প্রচার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোহামেদ মুইজ।
তারপর গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়াম শিউনা এবং অন্যান্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।
ভারতে ট্রেন্ড করতে থাকে ‘বয়কট মালদ্বীপ’– যার জেরে ভারত থেকে সে দেশে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যাও প্রভাব পড়ে।
ক্ষমতায় আসার আগেই মালদ্বীপ থেকে বিদেশি সেনা সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুইজ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর চীন সফরে যান এবং তারপর ফিরে এসেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বার্তা দেন দিল্লিকে। এরজন্য সময়ও বেঁধে দেন।
প্রকারান্তরে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, ভারত ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।
অন্যদিকে, ভারত বরাবরই দাবি করেছে, মানবিক সহায়তা ও জনকল্যামূলক সহযোগিতার জন্যই সেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। একে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়।
এদিকে পর্যটকদের একটা বড় অংশ মালদ্বীপের পরিবর্তে অন্য জায়গাকে পর্যটনের জন্য বেছে নেন।
তবে সমীকরণে পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। গত বছর প্রেসিডেন্ট মুইজ ভারত সফরে আসেন। সেই সময় ভারতের পক্ষে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সময় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন সম্পর্কের বরফ গলছে।
অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিশেষত দেশের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ার ফলে মুইজ সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়ার বিষয়গুলো রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
একইসঙ্গে, এই দ্বীপরাষ্ট্রকে ভারতেরও প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন