হিল্লোল পুরকায়স্থ, দিরাই //
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের তরুণ পার্থ দাস রনি। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে মাথায় ছিল ৯ সদস্যের বিশাল সংসারের চিন্তা। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে রনি বেছে নিয়েছিলেন অভিনয়ের পথ। তবে যাত্রাপালায় ‘নারী সেজে’ দর্শকদের হাততালি আর প্রশংসা কুড়িয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল রনির, কিন্তু পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ১৭ বছর বয়সী এই তরুণকে আসতে হল জীবনের বাস্তব মঞ্চে, সম্প্রতি নতুন চরিত্রে রনি এখন চাকরি খুঁজছেন ঢাকার ব্যস্ত অলিগলিতে।
জানা যায়, গ্রামের নাটকের যাত্রাপালায় নারী চরিত্রে অভিনয় করে যে সামান্য আয় হতো, তা দিয়েই চলতো রনির নিজের লেখাপড়া। পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতাও করতো সে। কিন্তু যাত্রার মৌসুমী এই পেশা সারাবছর আয় দেয় না, আর সংসারের ক্রমবর্ধমান চাপও আর সহ্য হচ্ছে না রনির। তাই বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে- আর মেয়ে সেজে অভিনয় নয়, রনি এখন পাড়ি জমিয়েছে ঢাকায়। এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন গার্মেন্টস ও ফ্যাক্টরিতে সিভি দিচ্ছেন রনি। পরিবারকে বাঁচাতে নিজের স্বপ্ন ও পরিচয়ের লড়াই থামিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে।
দুর্গাপুর গ্রামের রনিদের প্রতিবেশি মিশন রানী দাস সিলেটভিউকে বলেন, রনিদের পরিবার একসময় চট্টগ্রামে বসবাস করত। তখন রনির বাবা প্রভাত মাহিস্য দাস ও জ্যাঠা রাখাল মাহিস্য দাস মিলে করতেন ফলের ব্যবসা। ভালই চলছিল যৌথ পরিবারটি। কিন্তু হঠাৎ রনির জ্যাঠা রাখাল দাসের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে সংসারের ভিত্তি। বাধ্য হয়ে রনির বাবা পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন দিরাইয়ের দুর্গাপুর গ্রামে। প্রভাত মাহিস্য দাস এখন অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোনোরকমে সংসার চালান। রনির কাকা কালীপদ মাহিস্য দাসও হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এতে ভাইয়ের পরিবারের ভার গিয়ে পড়ে রনির বাবা প্রভাত দাসের কাঁধে। তিনি বলেন, পার্থ দাস রনি তখনো স্কুলে পড়ে, তখনই রনি গ্রাম্য যাত্রাপালায় অভিনয়ের সুযোগ পান। প্রথমদিকে নারী চরিত্রে অভিনয় করে গাইতেন গান, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন দক্ষ নারী চরিত্রে অভিনয়ে।
প্রতিটি শোতে ১২০০ টাকার মতো পেতাম উল্লেখ করে মুঠোফোনে রনি সিলেটভিউকে বলেন, ‘প্রথমদিকে শখের বসে অভিনয় শুরু করলেও পরবর্তীতে যখন বুঝলাম এর আয় দিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করা যায় তখন থেকে অভিনয়টা নিয়মিত করতে থাকি। আর এই টাকা দিয়েই বাবাকে সহায়তা করতাম। ভাইবোনদের স্কুলে পাঠানোর খরচ দিতাম। কিন্তু এই আয় দিয়ে পরিবারকে তেমন সহযোগিতা করতে পারি না। যাত্রা হয় বছরে ৫—৬ মাস। বাকি সময় আয় থাকে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে, পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখন ঢাকায় এসে চাকরি খুঁজছি। কয়েক জায়গায় সিভি দিয়েছি, এক বন্ধুর বাসায় থাকছি।’
রনি আরও বলেন, ‘আমার বাবার ইচ্ছে ছিল ভাল কীর্তনীয়া হবো। কিন্তু এর জন্য টাকা পয়সা দরকার। এদিকে পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ, তাই সব স্বপ্ন বাদ দিয়ে ঢাকাতে চলে এসেছি। এখন একটা কিছুতে ঢুকতে পারলেই হলো বলে জানান রনি।’
দুর্গাপুর গ্রামের অখিল দাস সিলেটভিউকে বলেন, ‘এই বছরই রনির এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবতার নির্মমতায় তাকে বই ফেলে তুলে নিতে হয়েছে জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার। রনি ছোটবেলা থেকেই ভদ্র, দায়িত্বশীল ছেলে। সে না থাকলে ওদের পরিবার এতদিনে ভেঙে পড়ত।’
গ্রামের তৃষ্ণা রানী দাস বলেন, ‘রনিদার মেয়ে সেজে অভিনয় করাটা আমার খুব ভালো লাগে। সে যেমন গান করে, এমন আর কেউ পারে না। বাদল দাস বলেন, আমরা রনির অভিনয় দেখেছি সে খুব ভাল অভিনয় করে। সুযোগ পেলে ছেলেটা জীবনে কিছু করতে পারতো।’

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন