হাকিকুল ইসলাম খোকন,
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে শুরু হওয়া অভিবাসনবিরোধী অভিযান আবারও যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং ও নির্মাণ খাতকে ব্যাপক চাপে ফেলেছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (ICE) সাম্প্রতিক ধরপাকড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অপ্রামাণিক অভিবাসীরা, বিশেষ করে নির্মাণশিল্পের শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়ে পড়ছেন চরম অনিশ্চয়তার মুখে। এর ফলে কেবল তাদের নিজস্ব বসবাসই ঝুঁকির মুখে নয়, গোটা দেশের আবাসন প্রকল্পগুলোও থমকে দাঁড়াচ্ছে।
নির্মাণশিল্পে অভিবাসী শ্রমিক নির্ভরতা : ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব হোম বিল্ডার্সের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণশ্রমিকদের অন্তত ২৫ শতাংশ অভিবাসী, যাদের একটি বড় অংশই অপ্রামাণিক। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ১৩ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিকই অনিয়মিত বা অপ্রামাণিক অভিবাসী। এরা মূলত এমন কাজ করেন, যেগুলোর জন্য স্থানীয় শ্রমিকেরা খুব একটা আগ্রহী নন-শারীরিকভাবে কষ্টকর, কম মজুরির কাজ।
হাউজিং সরবরাহ হুমকির মুখে : এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং বাজার ইতিমধ্যেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত- মর্টগেজ সুদের হার বৃদ্ধি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং শ্রমিক ঘাটতির কারণে বহু প্রকল্প স্থবির হয়ে আছে। শ্রমিক সংকটের কারণে ঘর নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে, প্রকল্পের খরচ বেড়েছে, ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ভাড়াটিয়া ও সম্ভাব্য ক্রেতারা। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫-এর প্রথমার্ধে নতুন আবাসন নির্মাণের সংখ্যা ১২.৫ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে ইউএস সেনসাস ব্যুরো।
শ্রমিক সংকটে প্রকল্প ব্যাহত : অ্যাসোসিয়েটেড জেনারেল কন্ট্রাক্টরস অব আমেরিকার ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ নির্মাণপ্রতিষ্ঠান দক্ষ শ্রমিক নিয়োগে সমস্যায় পড়েছে। এখন পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় কিছু প্রতিষ্ঠান উচ্চ মজুরি বা অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে লোক নিয়োগের চেষ্টা করলেও তেমন সাড়া মিলছে না। ফলে নির্মাণ বিলম্বিত হচ্ছে এবং ব্যয় বেড়েই চলেছে।
অভিবাসী শ্রমিকদের মানবিক দৃষ্টিকোণ : বিভিন্ন অধিকার সংগঠন অভিবাসী শ্রমিকদের অবদানকে সম্মান জানানোর আহ্বান জানাচ্ছে। তারা বলছে, অভিবাসীরা প্রতিদিন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত থেকে হাউজিং খাত সচল রাখেন। এই শ্রমিকদের হঠাৎ করে বহিষ্কার করায় নির্মাণসাইটে দক্ষতার ঘাটতি দেখা দেয়, যা কেবল উৎপাদনশীলতা নয়, নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে।
বহিষ্কার ও আইস রেইডের প্রভাব : ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে সম্প্রতি আইসের অভিযান ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু শ্রমিককে কাজের স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে নির্মাণ প্রকল্পগুলোর কাজ থেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার মতো রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেখানে একদিকে ঘরের চাহিদা প্রবল, অন্যদিকে শ্রমিক সংকট প্রকট।
বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম : ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব হোম বিল্ডার্সের (NAHB) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের পর থেকে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০২৩ সালে গড়ে কাঠ, ইস্পাতসহ প্রধান উপকরণগুলোর সরবরাহে ২৫ শতাংশ বিলম্ব হয়েছে, যা আরও বেশি সময় এবং খরচ বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। ঘরবাড়ির সরবরাহ কমছে, নির্মাণব্যয় বাড়ছে এবং বহু অভিবাসী পরিবার এখন ভয় পাচ্ছে, কবে তাদের জীবনের আশ্রয়টাই কেড়ে নেওয়া হবে। এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অভিবাসন নীতি, যাতে অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং মানবিক মূল্যবোধ একসঙ্গে বিবেচনায় আসে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন