ক্ষমতা, স্বার্থ আর নৈতিকতার সংঘাত! 

gbn

পক্ষ কিংবা বিপক্ষ বিবেচনায় নয় বরং ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যার বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে....

রাজু আহমেদ,  কলাম লেখক। 

আমরা আসলে খুনোখুনি-জখম সহ্য করতে পারি কিন্তু কোন হিন্দুর হাতে মুসলিমের হত্যাকাণ্ড কিংবা মুসলিমের আঘাতে হিন্দুর জীবনহানি সহ্য করতে পারি না! নিজেরা নিজেরা জীবন হরণ-পূরণ করলে তাতে দোষ নাই! বিগত কয়েক বছরে কত নির্দোষ মানুষ কতভাবে খুন হয়েছে- ক'জনের হত্যাকাণ্ড আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে? কতগুলো খুনের প্রতিবাদ আমরা করেছিলাম? অথচ এর প্রত্যেকটাই জীবন ছিলো। কোথাও না কোথাও মূল্যবান ছিলো। কারো না কারো কাছে সেই জীবনগুলো তাদের জীবনেরও অংশ ছিলো। তখন আমরা বেছে বেছে দল-মত-পথ দেখে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। যে আমার পক্ষের, আমার দলের কিংবা যেটা নিয়ে রাজনীতির ফায়দা হাসিল করা যায় সেই হত্যাকাণ্ডগুলোতে সোচ্চার হয়েছিলাম। কেননা কারো কারো জীবন কাউকে কাউকে লাভবান করে। আবার লাশ নিয়েও দেনদরবার করা যায়। 

 

এই যে কত হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে গ্রেফতার হলো- সেসব সম্পর্কে আমাদের মতামত-মন্তব্য কি ছিল? আমরা কি প্রত্যেক ন্যায়ের পক্ষে এবং প্রত্যেকটি অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম? দাঁড়াইনি। কেন? বিবিধ স্বার্থ-শোধের হিসাবনিকাশ মিলানোর ছিলো। প্রতিহিংসা চরিতার্থের সুযোগ দিয়েছিল। যখনই কাউকে চাপা রাখা যাবে, আলোচনায় আসা যাবে কিংবা জনমত ভাগানো যাবে- তখন আমি বিবৃতি দিয়েছি। পত্রিকায় প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছি। টকশোতে লম্বা বয়ান করেছি। ভিন্ন দেশে কেউ গ্রেফতার হয়েছে এবং অন্যদেশ সেটা নিয়ে উঠেপড়ে লাগলে আপনি ভাবছেন এর উদ্দেশ্য ভালো? মোটেই না বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হাজার অন্যায়ের সময় যখন আমি চুপ থাকি এবং যে অন্যায়টা আমার বিরুদ্ধে হয় সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই- তখন সিমপ্যাথি সেক হয় না।  বরং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ধর্মান্ধ ও দলান্ধের পক্ষপাতিত্ব কোন কালেই মঙ্গলের হয়নি। 

 

দেশরক্ষার রাজনীতির চেয়ে স্বার্থরক্ষার রাজনীতি যখন প্রাধান্য পায় তখন দেশের সুনাম-ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। যে পক্ষ ক্ষমতায় তাদের বিরুদ্ধে আরেকপক্ষ অসমতার দাবি তুলে দেশে বিদেশে অপপ্রচার চালায়। ফলাফল পক্ষ-বিপক্ষ থেকে বহির্বিশ্বে দেশ সম্পর্কে মন্দ বার্তা যায়। অথচ সবদল দাবি করে এটাই তাদের স্বদেশ এবং তারা দেশপ্রেমিক। ক্ষমতার জন্য বিদেশি প্রভূদের কাছে কেউ চিঠি লেখে আবার কেউ কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। এতে দেশের মানসম্মান কোথায় খাঁড়ায় তা তারা ভাবে কিনা সেটা নিয়ে তর্কবিদ্যার চর্চা করা যেতে পারে। যেকোনো ভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতাই দেশটাকে বারবার দুর্বিপাকে পতিত করেছে। সংকটের দুর্দশা এবং আস্থাহীনতার সংকট কখনোই দেশটার পিছু ছাড়েনি। একের পর এক  নানামুখী ষড়যন্ত্রের কবলে দেশটা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

 

মানুষ যখন নিজের সুবিধার জন্য ন্যায়-অন্যায়ের পক্ষপাত বিবেচনা করে না তখন সে হয় সকালে নয় বিকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। কেননা সবার সুদিন দিয়ে মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানো হয় নাই। সুবিধার্থে অন্যায়ের সাপোর্ট করলে ন্যায় পরাজিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু সত্য তো শেষমেশ হারে না। সে সহজাতভাবে বিদ্রোহ করে এবং ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠে। কাজেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে অন্ধভাবে অন্যায়ের পক্ষ নিলে ন্যায়ের কাছেও দায় চুকাতে হয়। পরের জন্য ফাঁদ পাতলে নিজেকেও অনুরূপ ফাঁদে আটক হতে হয়। তখন সেটায় খেসারত বাড়ে। সীমাহীন সম্মানহানি ঘটায়। ভারসাম্যের পৃথিবীতে একদল কেবল শাসন করবে আরেকদল শোষিত হবে- এই নীতি কখনোই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার চেয়ারে জুলুমাত বেড়ে গেলে পতনও গভীর হয় এবং ক্ষতির খতিয়ান দীর্ঘ হয়।

 

পক্ষ কিংবা বিপক্ষ বিবেচনায় নয় বরং ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যার বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। কেউ সুবিধাবাদী হচ্ছে ভেবে শত অন্যায়ের সময় যে চুপ থাকে, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে যারা অন্যায় উপভোগের নিস্ক্রিয় দর্শক হয় তারা যখন বিপক্ষ শিবিরে থাকে তখন তারাও অনুরূপ প্রতিহিংসার শিকার হয়। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধের অংশ। আর যারা সবকিছু ন্যায্যতার মানদণ্ডে বিবেচনা করে তারা কখনোই বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পতিত হয় না। বরং কোথাও সাময়িকের জন্য বাঁধাগ্রস্থ হলেও পরক্ষণেই উৎরে যায়। কারো ওপর অন্যায় হচ্ছে আর আমি চুপ করে বসে আছি, মজা দেখছি- এই পরিস্থিতি বিপরীত সময়ে যখন আমার সাথে অন্যায় ঘটবে তখন গোটা ব্রহ্মাণ্ড নিরব ভূমিকা পালন করবে। কেননা অন্যায়ের দায় এবং ন্যায়ের ঋণ অস্বীকার করার সুযোগ নাই। বরং দেনা যত বাড়বে সেগুলোর ঋণ শোধবোধের তাড়াও বাড়বে। 

 

অন্যায় যে পরিবেশেই ঘটুক, অন্যায্য যার সাথেই ঘটুক প্রতিবাদ জানাতে হবে। ক্ষমতা না থাকলে নিদেনপক্ষে ঘৃণা করতে হবে। শত্রুপক্ষের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সময়, হয়রানি হওয়ার কালে যদি হাসি এবং সুখ সুখ অনুভব করি তবে মানুষের দলে নাম রাখার সুযোগ নাই। সময় রঙ পাল্টাবে। দুনিয়ার বাতাস যখন বিপরীত থেকে বইতে শুরু করবে, ক্ষমতার ছড়ি যখন উল্টে যাবে তখন আমিও ক্ষতির দ্বার দিয়ে ধ্বংসের গৃহে প্রবেশ করবো কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়ার কেউ থাকবে না। পাছে যা ফেলে আসি ভবিষ্যৎ সেটাই ফিরিয়ে দেয়। কাজেই সত্য বলতে যাতে দ্বিধাহীন না হই। কোন ভয় বা প্রলোভন সত্যের যাত্রায় দেয়াল না তোলে। অন্যায়ের প্রতিবাদে আমাকে যাতে কোন স্বার্থ এবং পক্ষপ্রীতি বিরত না রাখে। যে অন্যায় আজ নিরবে সয়ে যাবো সে অন্যায় আগামীকাল আমার সাথে দেখা করবেই। অন্যায় সর্বদাই সংক্রমিত হয়। যত স্পেস পাবে অন্যায়ের কলেবর তত বৃদ্ধি পাবে।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন