হুসনা খান হাসি ||
শৈশব থেকেই অনেক পুরুষকে প্রায় অজান্তে শেখানো হয় তাদের আবেগ প্রকাশে সংযম রাখতে। এটি কোনো একক শিক্ষার ফল নয়, বরং নানা ছোট ছোট ইঙ্গিতের সমষ্টি, যা প্লে গ্রাউন্ড থেকে শুরু করে পরিবারের ডিনার টেবিল পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে, এবং বারবার দেখায় যে কোমলতা শক্তির তুলনায় দুর্বলতার পরিচয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা শিখে যায় যে দুঃখ, ভয় বা উদ্বেগের মতো অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা ঠিক নয়। বড় হয়ে এই অখণ্ড শিক্ষা তাদের আচরণ, সম্পর্ক এবং মানসিক সুস্থতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, ফলে অনেক পুরুষ নিজেদের আবেগের সঙ্গে একাকী হয়ে পড়ে।
এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়ি থেকে। একটি ছেলের আবেগীয় নিয়ন্ত্রণের প্রথম পাঠ প্রায়ই বাড়ি থেকেই আসে। উদাহরণস্বরূপ, যদি সে পড়ে যায় বা কাঁদে, তখন তাকে বলা হতে পারে “পুরুষের মতো আচরণ করো” বা শিশুসুলভ আচরণ বন্ধ করো। ভালোবাসার সঙ্গে বলা হলেও, এই ধরনের কথাগুলি ইঙ্গিত দেয় যে আবেগ প্রকাশ করা ঠিক নয়। গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, ছেলে শিশুরা মেয়েদের তুলনায় বাড়িতে ভয় বা দুঃখ প্রকাশ করতে বেশি বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আবেগকে দমন করতে পারে। এই প্রাথমিক অভিজ্ঞতাগুলো ছেলেদের বোঝায় যে তাদের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো অপ্রয়োজনীয় বা অস্বস্তিকর।
এর পাশাপাশি, ছেলেরা সরাসরি নির্দেশ না পেলেও পুরুষ আচরণের ধরন পর্যবেক্ষণ করে শেখে। পিতা, বড় ভাই বা মামা, চাচারা প্রায়শই আবেগ নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ হিসেবে থাকেন, কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্বেগ বা দুঃখ প্রকাশ কমই করেন। একটি শিশু এই আচরণ দেখে ধারণা পেতে পারে যে বড় হওয়া মানেই ধৈর্যশীল হওয়া, আর অনুভূতি প্রকাশ করা দুর্বলতার সঙ্গে সমান। পরিবারের মধ্যে খোলাখুলি আবেগের অভাব অজান্তেই শক্তিকে নীরবতার সমার্থক হিসেবে চিত্রায়িত করে।
অন্যদিকে, বিদ্যালয়েও এই ধরনের মানসিক চাপ উভয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে প্রচলিত। সাধারণত ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, শারীরিক শক্তি এবং দৃঢ়তার প্রশংসা করা হয়, আর সংবেদনশীল হওয়াকে হাস্যরসের লক্ষ্য বানানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, Child Development জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্কুলে ভয় বা দুঃখ প্রকাশ করে তারা মেয়েদের তুলনায় সামাজিকভাবে বেশি প্রত্যাখ্যাত হয়। সহপাঠীদের ছোটোখাটো ঠাট্টা ছেলেদের শেখায় যে আবেগপ্রকাশ করা সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, ফলে তারা আবেগকে ঢেকে রাখার এবং শক্তিশালী বা অপ্রতিরোধ্য অভিনয় করার অভ্যাস গড়ে তোলে।
কিশোরাবস্থায় সামাজিক পরিবেশ আবেগ প্রকাশের পথে আরও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ছেলেদের বন্ধুত্ব সাধারণত মিলিত কার্যক্রম, হাস্যরস এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে, যেখানে আবেগপূর্ণ কথোপকথনের স্থান কম থাকে। যদি কোনো কিশোর হৃদয়ভঙ্গ, উদ্বেগ বা একাকীত্ব প্রকাশ করতে চায়, তাকে দুর্বল বা “অতিরিক্ত সংবেদনশীল” মনে করা হতে পারে। এই ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বারবার জোর দেয় যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা সামাজিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য অপরিহার্য।
এছাড়াও, মিডিয়ার প্রভাব এই বার্তাকে আরও শক্তিশালী করে। সুপারহিরো, অ্যাকশন তারকা এবং জনপ্রিয় সিনেমার পুরুষ নায়কদের মধ্যে প্রায়শই দুর্বলতা দেখা যায় না। এমনকি যখন তারা কষ্ট বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তারা সাধারণত ভয় বা দুঃখ প্রকাশ না করে সমস্যার সমাধান করে। জিনা ডেভিস ইনস্টিটিউট অন জেন্ডার ইন মিডিয়ার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পর্দায় পুরুষ চরিত্রদের দুঃখ বা সহানুভূতি দেখানোর সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় তিনগুণ কম। এর ফলে, এই ধরনের চিত্রে বড় হওয়া ছেলেরা মনে করতে শুরু করে যে শক্তিশালী হওয়া মানে আবেগকে দমন করা।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই চাপ কর্মক্ষেত্রেও প্রবেশ করে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা পেশাগত পরিবেশে একই ধরনের প্রত্যাশার মুখোমুখি হয়। অনেক কর্মক্ষেত্র ধৈর্য এবং সমস্যা সমাধানকে পুরস্কৃত করে, আবেগ প্রকাশকে কম উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যে পুরুষরা চাপ বা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা স্বীকার করে, তারা উদ্বিগ্ন থাকে যে তাদের অযোগ্য বা নেতৃত্বের উপযুক্ত নয় বলে ভাবা হবে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬০% পুরুষ অনুভব করেন যে কাজের জায়গায় সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকার চাপ রয়েছে, তাদের প্রকৃত আবেগিক অবস্থার উপেক্ষা করেই।
এই চাপের প্রভাব বিশেষভাবে রোমান্টিক এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। সঙ্গীরা এই আবেগ ভাগাভাগি করার জন্য উৎসাহ যোগাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শেখা দমন প্রথা বাধা সৃষ্টি করে। পুরুষরা প্রেম, দুঃখ বা অনিশ্চয়তা প্রকাশ করতে হিমশিম খেতে পারে, এমন ভয়ে যে তাদের দুর্বলতা শক্তিকে ক্ষীণ করবে। এর ফলে উভয় পক্ষই হতাশার মুখোমুখি হয় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণকে পুরুষত্বের স্বরূপ হিসেবে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদিভাবে আবেগ দমন মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। যারা নিয়মিত নিজের অনুভূতিগুলো চাপা দেয়, তাদের মধ্যে স্ট্রেস, বিষণ্নতা ও উদ্বেগের হার বেশি দেখা যায়। Psychology of Men & Masculinity জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কড়া প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক মানদণ্ড মেনে চলে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা তাদের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি যারা আবেগ প্রকাশে বেশি নমনীয়। তাই আবেগ চাপা রাখা শুধুমাত্র অস্বস্তি নয়, এটি মানসিক সুস্থতার জন্য বাস্তব ঝুঁকিও সৃষ্টি করে।
সামাজিকভাবে, এর প্রভাব আরও গভীর। যারা নিজেদের দুর্বল বা নরম অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না, তারা প্রায়শই রাগ বা আগ্রাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভয়, দুঃখ এবং কোমলতা অদৃশ্য হয়ে যায়, যা আচরণের অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং সম্পর্ক, পিতৃত্ব ও সম্প্রদায়ের যোগাযোগকে প্রভাবিত করে। গৃহহিংসার গবেষণা নির্দেশ করে, আবেগ দমন প্রায়শই সংঘাতের উৎস হয়ে ওঠে, কারণ দমনকৃত অনুভূতি রাগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
তবুও, এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, পরিবর্তন সম্ভব। পরিবারগুলো এখন ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই তাদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। স্কুলগুলো আবেগীয় সাক্ষরতা শেখানোর প্রোগ্রাম চালু করছে, যা শিশুদের নিজেদের অনুভূতি চেনা ও প্রকাশ করতে সাহায্য করছে। বিভিন্ন সংস্থা পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বাড়াচ্ছে এবং এমন পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে দুর্বলতা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে সামাজিক ধ্যানধারণা পরিবর্তনযোগ্য এবং পুরুষরাও সম্পূর্ণরূপে মানুষের আবেগ অনুভব করতে পারে।
সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলা আবেগ দমন পুরুষদের উপর মানসিক, সম্পর্কগত ও সামাজিক ভাবে গভীর প্রভাব ফেলেছে।। কিন্তু আসল শক্তি আসে নীরবতা নয়, বরং নিজের অভ্যন্তরীণ অনুভূতির মুখোমুখি হওয়া এবং তা প্রকাশ করার সাহস থেকে। যখন ছেলেরা শেখে যে আবেগ প্রকাশ করা স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর, তারা আরও পূর্ণ এবং সত্যিকার জীবন যাপন করতে পারে। এই পরিবর্তন গ্রহণ করা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নয়, বরং সমাজের জন্যও লাভজনক, এটি সহানুভূতি, সংযোগ এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন