শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক ||
ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে জনবহুল মাক্কায় ‘উকবা ইবন আবি মু’য়ায়িত নামে কোরাইশ গোত্রে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন । একবার তিনি ভ্রমণ থেকে ফেরে তার বাড়িতে এক ভোজের আয়োজন করেন এবং নবী মুহাম্মদ (সা:) কে দাওয়াত দেন। কিন্তু নবী (সা:) নিজ মিশনে ছিলেন দৃঢ় । তিনি বললেন, “তুমি সাক্ষ্য দাও যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি তাঁর রাসূল, তাহলে আমি তোমার খাবার খাব।” ভদ্রতা, কৌতূহল—বা হয়তো অন্তরে জাগা সামান্য সত্যের আলো—এর কারণে ‘উকবা শাহাদাহ উচ্চারণ করলেন। কিন্তু সেই সত্যের মুহূর্তটি স্থায়ী হয়নি।
যখন তার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং নবীর (সা:) এর প্রবল শত্রু ‘উবাই ইবন খলফ ঘটনাটি শুনল, সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল । সে ‘উকবাকে ঠাট্টা করে বলল, “তুমি কি পূর্বপুরুষদের ধর্ম ছেড়ে দিলে? ধর্মের প্রতি তোমার অনুগত্য প্রমাণ করতে মুহাম্মদের (সা:)-এর মুখে থুথু ফেলো।”
বন্ধুর চাপে পড়ে, মান-সম্মান হারানোর ভয় থেকে ‘উকবা অকল্পনীয় কাজটি করল—নবী (সা:) এর মুখে থুথু ফেলল । কিছু প্রাচীন আলেম বলেন, আল্লাহ সেই থুথুকে দিয়ে ‘উকবার মুখে দাগ এঁকে দিলেন, যা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। পরে বদরের যুদ্ধে সে অপমানজনকভাবে মারা যায়। তার সঙ্গী ‘উবাইও উহুদের যুদ্ধে একই পরিণতি ভোগ করে।
এই ঘটনার পরে আল্লাহ বলেন—“সেদিন অন্যায়কারী তার দুই হাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে: ‘হায়! যদি আমি রাসূলের সাথে পথ নিতাম ! হায় আফসোস ! যদি আমি অমুককে বন্ধু না বানাতাম! সে তো আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল, যদিও উপদেশ আমার কাছে এসেছিল ।’” কুরআন ২৫:২৭–২৯
এই আয়াতে এক শক্তিশালী চিত্র ফুটে ওঠেছে। কিয়ামতের দিন কেউ হাত কামড়াচ্ছে আফসোসে, কারণ সম্পদ, মান-সম্মান বা খ্যাতি হারানোর জন্য নয়—এক ভুল বন্ধুত্বের জন্য। ‘উকবার ভুল সঙ্গ আমাদের জন্য বড় শিক্ষা । আজও খারাপ বন্ধু সেই, যে বলে—“নামাজ পরে পড়বে, পাঁচ ওয়াক্ত বেশি হয়ে যায়, আজ বাদ দাও, আরেকদিন হবে।” খারাপ বন্ধু এভাবে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেয়, ঈমানকে লজ্জার কিছু মনে করায়, আর পাপকে ছোট ও স্বাভাবিক করে দেখায়।
নবী (সা:) পরিষ্কারভাবে বলেছেন—“মানুষ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ধর্মের উপর থাকে । তাই তোমরা দেখে নাও কার সাথে বন্ধুত্ব করছ।” আমরা এই উপদেশকে হালকা করে নিতে পারি না। দুনিয়ায় যাদের সাথে সময় কাটাই—হাসি-ঠাট্টা করি—কিয়ামতের দিনে তারা পাশে থাকবে না বরং হয়তো তাদের কারণেই পাল্লা ভারী হবে ভুল দিকে।
এই ঘটনা একা নয় । নবীকে সারাজীবন রক্ষা করা তাঁর চাচা আবু তালিবও মৃত্যুশয্যায় ইসলামের দিকে আসতে পারেননি। নবী (সা:) বারবার অনুরোধ করলেন—“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো—এটাই হবে আমার সুপারিশের কারণ।”
কিন্তু তার বন্ধু আবু জাহেল ও আবদুল্লাহ ইবন আবি উমাইয়া চাপ দিয়ে বললো, “তুমি কি তোমার পিতৃপুরুষদের ধর্ম ছাড়বে?” সঙ্গীর প্রভাবের কারনেই তিনি পুরোনো ধর্মে মৃত্যু বরণ করলেন।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন—“আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে সঠিক পথে আনতে পারবেন না, আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকেই পথ দেখান। (কুরআন ২৮:৫৬)। এতে বোঝা যায়—ভালো সঙ্গ পেলেও, যদি আমরা নিজেদের চারপাশে ভুল মানুষ রাখি, তারা আমাদের টেনে নিচে নামিয়ে দেবে।
তাহলে ভালো বন্ধু কেমন? যে তোমাকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয় । তুমি দেরি করলে নামাজে ডাক দেয় । তোমার ভালো কাজ দেখে খুশি হয়। ভুল করলে নরমভাবে সংশোধন করে । তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার সম্মান রক্ষা করে। তোমার জন্য জান্নাত কামনা করে।
আজকের যুগে সঙ্গ শুধু সরাসরি মানুষের সাথে নয়—অনলাইনেও হয়ে থাকে। যাদের অনুসরণ করি, তারা আমাদের চিন্তাভাবনা পাল্টে দিতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুরাও কখনো ঈমান বাড়ায়, কখনো কমিয়ে দেয়।
কিছুদিন আগে এক কিশোর আমাকে বলে—সে ইসলাম নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছিল। কারণ টিকটক আর ইনস্টাগ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো। সেখানে সে দেখছে বিলাসিতা, খ্যাতি—এতে মনে হয়েছে অন্যদের সব কিছু আছে, তার কিছুই নেই। সে বাস্তবতার সাথে তুলনা করছিল না—তুলনা করছিল সাজানো, আবেগ-নির্ভর ভিডিওর সাথে। শয়তানের ধোঁকা এমনই হয়—সরাসরি কুফর দিয়ে নয়, অনেক সময় হিংসা, হতাশা আর ভুল সঙ্গ দিয়ে।
তাই নিজেকে প্রশ্ন করো—তুমি অসুস্থ হলে কে দেখতে যাবে? আজ যদি তুমি মারা যাও—কারা জানাজায় সামনের কাতারে দাঁড়াবে? আর তুমি কাকে সেখানে পেতে চাও? কারণ জান্নাতের পথ একা হাঁটার নয়—সঙ্গীরা হয় তোমাকে এগিয়ে নেবে, নয়তো টেনে নামাবে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন সৎ সঙ্গ দান করুন, যারা আপনাকে মানতে সাহায্য করবে; যাদের মাধ্যমে আমরা আপনাকে স্মরণ করব; যারা আমাদের ভুল ক্ষমা করবে; এবং কখনো এমন কাউকে বন্ধু বানাতে দেবেন না—যে আমাদের আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমীন।
শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন