অপ্রাপ্তির আড়ালে লুকানো প্রাপ্তি

gbn

আমরা প্রায়ই যা হারাই, তাই নিয়ে ভেঙে পড়ি

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক। 

পাওয়াটাই চূড়ান্ত প্রাপ্তি নয়, আবার না পাওয়াটাও সবসময় অপ্রাপ্তি নয়। মানুষের কীসে কল্যাণ আর কীসে অকল্যাণ, তা বাহ্যদৃষ্টিতে নির্ণয় করা যায় না। আহমেদাবাদের যানজটে আটকে ভূমি চৌহানের লন্ডনগামী ফ্লাইট মিস করাকে প্রথমে ব্যর্থতা মনে হলেও, সেই মুহূর্তটিই হয়ে ওঠে তার জীবনের মোড় ঘোরানো পরম আশীর্বাদ। সময়জ্ঞান হারানো নিয়ে যে পরিবার তাকে ভৎসনা করত, সেই পরিবারই তার শেষকৃত্যের আয়োজন করত যদি সে বোয়িংটিতে চড়তে পারত। দশ মিনিটের দেরিতেই রক্ষা পায় একটি জীবন—এটাই এখন অনিবার্য বাস্তবতা।

 

আমরা প্রায়ই যা হারাই, তাই নিয়ে ভেঙে পড়ি। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জীবনের দিশা হারিয়ে ফেলি। জীবনকে শেষ করে দেওয়াও পথ খুঁজি। অথচ মনের মানুষকে পেয়েও কেউ কেউ অশান্তির অগ্নিতে দগ্ধ হয়। মানুষ এই সহজ অথচ গভীর সত্যকে ধারণ করতে পারে না—না পাওয়াও ব্যর্থতা নয়। সেই বোধের অভাবেই বহুবার দ্বিতীয় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, কারণ প্রথম ক্ষত এখনও শোকাচ্ছন্ন। মানুষ তার জীবনের ক্ষুদ্র পরিকল্পনাকারী; অথচ স্রষ্টা, মহাপরিকল্পনাকারী, জানেন কাদের কীসে কল্যাণ। তিনি কাউকে দান করে রক্ষা করেন, আবার কাউকে বঞ্চিত করেও কল্যাণময় রাখেন।

 

আমরা প্রবৃত্তির টানে বিচার করি, বাহ্যিক ফল দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। কিন্তু সত্যিকারের ন্যায্যতা বহুস্তরবিশিষ্ট—অন্তর্দৃষ্টিহীনতায় তা অনুধাবন করা যায় না। তাই মানুষের উচিত কেবল নিজের চেষ্টা নয়, বরং নিয়তির ওপর আস্থা রাখা। কারণ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পথ সবসময় একই রেখায় চলতে না-ও পারে। এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে এক মহান উদ্দেশ্য। শৃঙ্খলার অন্তরালে কাজ করেন এক মহান সত্য। 

 

একটি গোলাপ না পাওয়ার দুঃখে চোখ ভিজে উঠতে পারে, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য না পেলে মন বিষণ্ন হতে পারে। কিন্তু স্রষ্টা তো গোলাপের বদলে একটি গোটা বাগান উপহার দিতে পারেন! ভাগ্যকে তিরস্কার করাটা দুর্বুদ্ধির পরিচায়ক, কারণ খালি চোখে যেটা আকর্ষণীয় মনে হয়, সেটার গভীরে থাকতে পারে অভিশপ্ত কোনো বাস্তবতা। অতএব, জীবন নিয়ে অকারণে সংশয় সৃষ্টি করে যেন আমরা নিজেদের স্বস্তি হরণ না করি। উচ্চাশা অনেক সময় অশান্তির জন্ম দেয়। যা চাই তা সবসময় মিলবে না, তাই বলে জীবন থেমে থাকতে পারে না।

 

জীবনে যত অভিযোগ জমে, সুখের পরিমাণ তত হ্রাস পায়। অন্যের সঙ্গে তুলনা করে ভালো থাকতে চাওয়াটাই দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত। প্রতিটি মানুষের ভাগ্য আলাদা; কারো সাফল্য অন্যের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে, অনুকরণীয় নয়। মানুষ চেষ্টায় সীমিত, ভাগ্য বদলে দেওয়ার ক্ষমতা তার হাতে নেই। তাই অল্পে তুষ্ট থাকা, ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসা, অন্যের কল্যাণে এগিয়ে আসার মাঝেই প্রকৃত জীবনের স্বার্থকতা নিহিত। মানুষের দোয়ায় বরকত আসে, আর নিঃস্ব হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসে ধ্বংস অনিবার্য হয়। যে আত্মা কৃতজ্ঞ থাকে, সে আত্মা প্রশান্তি পায়। হতাশা ছিন্ন করে, অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে যে যাত্রা করে, সেই তো প্রকৃত বিজয়ী।

 

৪০তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারের মোঃ ঝন্টু আলী—একজন সম্ভাবনাময় তরুণ, ক্যান্সারের কাছে হার মেনে বিদায় নেয়। দুনিয়ার মাপকাঠিতে যা ছিল সাফল্যের শীর্ষ—ত্রিশে পা রাখা এক তরুণের স্বপ্নপূরণ—তা তার আয়ুর পরিধিতে বিকশিত হওয়ার সুযোগই পেল না। তাহলে চূড়ান্ত সফলতা আসলে কীসে? আরেকটি প্রসঙ্গে, ক্যান্সার আক্রান্ত একটি ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “বড় হয়ে কী হতে চাও?” সে বলেছিল, “বড় হওয়া পর্যন্ত বাঁচতে চাই।” এই সরল উত্তরেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে নির্মম কিন্তু সত্যান্বিত সংজ্ঞা।

 

জীবনের প্রতিটি দিনই একটি অবসরের নাম। যে দিনের সঙ্গে দেখা হয়, সে দিনকেই উপভোগ্য করে তোলার মধ্যেই জীবনের সৌন্দর্য। মানুষকে ঠকিয়ে, অধিকার হরণ করে কেউ কখনো প্রকৃত সুখী হতে পারে না। তবুও কেন মানুষের মনে কুচিন্তা জন্মায়? কেন সে নিজের কল্যাণে অন্যের অকল্যাণ কামনা করে?

 

জীবনের পথ চলা হতাশার কুয়াশায় নয়, আশার আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া উচিত। না পেলেই যে জীবন বৃথা হয়ে যায়, তা নয়। বরং কীসে প্রকৃত মঙ্গল, সেটি বুঝে তা স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিতে হবে। সফলতা বা বিফলতা, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরীয় সন্তুষ্টির ছায়াতলে নির্ভরশীল। দায়িত্ব পালনের কঠোরতায় যে অবিচল থাকে, সে কখনো আশাহীন হয় না। শতবার ব্যর্থ হয়েও যে বারবার উঠে দাঁড়াতে পারে, সেই এগিয়ে যায় সর্বাগ্রে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বীজ বপন করাই হবে আমাদের কর্তব্য। কারণ, না পাওয়া মানেই পরাজয় নয়; কখনো অপ্রাপ্তির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মহামূল্যবান প্রাপ্তির সম্ভাবনা।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন