‘হাকিকুল ইসলাম খোকন,
স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’এর প্রতিষ্ঠাতা ও রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খানের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার ,১০ জুন নিউইয়র্কে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁতে প্রবাসী নাগরিকদের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
হাজি আনোয়ার হোসেন লিটনের পরিচালনায় উক্ত সভায় উপস্থিত ও বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন , অধ্যাপক জিয়া উদ্দিন দেলোয়ার , লাভলু সরকার , আবুল হাসান , মিয়া মোহাম্মদ মারুফ , প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম , এডভোকেট সুমন আহমদ , কাজী ইব্রাহিম খলিল , বুরহান উদ্দিন , ইকবাল আহমেদ , রাদিব আহমেদ জুয়েল সহ অনেকে।
বক্তারা বলেন ,প্রয়াত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশিদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে, তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা।
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণের কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে এলে আওয়ামী লীগ ও মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। গড়ে তোলেন একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত 'অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার সাথে ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের। কিন্তু ক্ষমতার লোভে এবং পদের মোহে অনেকে আজকে সিরাজুল আলম খানের কোন অনুষ্ঠানে ও যেতে আগ্রহী নন।
বক্তারা আরো বলেন , নিউক্লিয়াসকে পরবর্তী সময়ে তারা ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ও বলেছেন অনেকে। আবার একটা সময় পর ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ বা বিএলএফ হিসেবে ডাকা হয়। এ বিএলএফের গেরিলা উইং হিসেবে ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সিরাজুল আলম খান ভারতের দেরাদুনে গড়ে তোলেন ‘জয়বাংলা বাহিনী’, যা সাধারণের কাছে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল।
বক্তারা বলেন , সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে আবার গ্রেফতার এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেফতার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।
বক্তারা বলেন, সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে উঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা।
মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসাবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চলভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থাসংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৪-৬৫ এ দুই সেশনে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা।
ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা রাখেন।
বক্তারা বলেন , বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনও মূল নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। কিন্তু একক ব্যক্তি রাজনীতির কারণে বাংলাদেশে অন্যদের ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে। সেটা জাতির জন্য লজ্জার।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন