হুসনা খান হাসি ||
সমাজে বহুদিন ধরে একটি ধারণা ঘুরে বেড়ায় যে নারীই নাকি নারীর চরম শত্রু। কথাটি শুনতে যেমন কষ্টদায়ক, বাস্তবে তেমনি জটিল। এই বিরোধকে সত্য ধরে নিলে ভুল হবে। বরং এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরও গভীর সত্য, থাকে না বলা গল্প, অস্বস্তি, ভয়, আর অনেক অচেনা চাপের স্রোত, যা চোখে পড়লেও আমরা বারবার এড়িয়ে যাই। এই ধারণার জন্ম মানবজীবনের গভীর অভিজ্ঞতা থেকে, কিন্তু তা কখনোই নারীর প্রকৃত স্বরূপকে সম্পূর্ণ তুলে ধরে না। বরং এটি একটি আয়না, যেখানে সমাজের ভাঙন, হিংসা, সীমাবদ্ধতা এবং ভুল বোঝাবুঝি প্রতিফলিত হয়।
নারীরা অনেক সময় নিজেদের শক্তিকে বুঝে ওঠার আগেই তুলনার ভেতরে পড়ে যায়। তারা যখন একে অন্যকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখে, এর পেছনে থাকে এক ধরনের অদৃশ্য চাপ। ভালোবাসা, স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, সম্মান এসবকে একটি সীমিত সম্পদ হিসেবে ভাবতে শেখানো হয়েছে তাদের। ফলে অজান্তেই সৃষ্টি হয় তুলনা, কে বেশি সুন্দর, কে বেশি সফল, কে বেশি গ্রহণযোগ্য, কে পরিবারের চোখে প্রিয়, কে সমাজের মানদণ্ডে মানানসই, এসব প্রশ্ন ধীরে ধীরে সম্পর্ককে ক্ষয় করে। তখন স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নেয় এক ধরনের ভয়, অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তা। সেই ভয়ই অন্য নারীর প্রতি অসম্ভব দূরত্ব তৈরি করে।
নারী নারীর বিরোধের আড়ালে থাকে আরেকটি বাস্তবতা; নারীদের আবেগ ও শক্তিকে বহুদিন ধরে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে তারা মনে করে সম্মান আর ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে হয়। মনে হয়, এক নারীর সাফল্য অন্য নারীর পথ সংকুচিত করে। অনেক সময় নারীরা নিজেদের ভেতরের দুঃখ, ব্যর্থতা বা না বলা ক্ষতকে অন্য নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়। যেন অন্যজনের পতনই নিজের ক্ষতের উপর প্রলেপ।
নারীরা যখন নিজেদের ক্ষত চেপে রাখে, তখন সেই চেপে রাখা দুঃখ অন্য নারীর প্রতি কঠোর হয়ে ওঠে। অথচ যদি সেই দুঃখ ভাগ করা যেতো, যদি তারা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতো যে তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযাত্রী, তবে বিরোধের গল্প বদলে যেতো। নারী নারীর বিরোধের আড়ালে আসলে যা লুকিয়ে থাকে, তা হলো স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টা, নিজের জায়গাটা হারিয়ে না ফেলার ভয়, আর থাকে সেই পুরোনো কাঠামো, যা নারীদের একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে নিজের সুবিধা ঘরে তোলে।
সত্যি বলতে কি, নারী জন্মগতভাবে নারীর বিরোধী নয়। বরং তাদের ভেতরে থাকে গভীর সহমর্মিতা। থাকে অন্যের বেদনা বুঝে ফেলার অদ্ভুত শক্তি। শুধু সেই শক্তি সব সময় ব্যবহার করার সুযোগ তারা পায় না।
নারী নারীর শত্রু তখনই, যখন সে নিজেকে দুর্বল মনে করে। অন্যের আলো দেখে ভয় পায়। নিজের শক্তিকে অবহেলা করে। আর নারী নারীর বন্ধু তখনই, যখন সে আরেক নারীর দৃঢ়তায় অনুপ্রাণিত হয়। তার সাফল্যে নিজের সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখে। তার বেদনা নিজের অভিজ্ঞতার মতো অনুভব করে।
নারীর সত্যিকারের শত্রু নারী নয়। শত্রু হলো সেই চিন্তা, যা সব নারীর কণ্ঠকে আলাদা আলাদা করে দেয়। সেই ভয়, যা তাদের একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে বাধা দেয়। সমাজের সেই পুরোনো কাঠামো, যা নারীর সাফল্যকে একটি সীমিত আসনের মধ্যে আটকে রাখতে চায়।
যখন নারীরা পরস্পরের হাত ধরে এগোয়, তখন তারা কেবল নিজেদের নয়, পুরো সমাজের পথ আলোকিত করে। প্রতিটি নারী অন্য নারীর যাত্রাকে সহজ করতে পারে। একটি প্রশংসা, একটি সাহসী কথা, একটি ছোট সহায়তা কখনো কখনো ভাঙা আত্মবিশ্বাসকে আবারও জীবন্ত করে তোলে।
যখন একজন নারী আরেকজনকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে নিজের মতনই একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে দেখে, তখন বিরোধ মুছে যায়। তখন শুরু হয় নতুন সম্পর্ক। সম্মানের সম্পর্ক, বোঝাপড়ার সম্পর্ক। তখন এক নারীর আলো অন্য নারীর পথ আলোকিত করে।
নারী যদি নারীর শত্রু হয়, তবে সেটি সমাজের নির্মিত একটি গল্প মাত্র। আর নারী যদি নারীর সহযাত্রী হয়, তবে সেটি এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা। সেই ভবিষ্যতে হিংসা ভেঙে পড়ে, শক্তি ভাগাভাগি হয়, আর এক নারীর সাফল্য আরেক নারীর পথ খুলে দেয়।
নারী নারীর চরম শত্রু নয়। নারী নারীর গভীর সম্ভাবনা।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন