হুসনা খান হাসি॥
নারী—এই শব্দটি কখনো কোমলতার প্রতিচ্ছবি, কখনো আবার শক্তির প্রতীক। যুগে যুগে সমাজ নারীর পরিচয়কে শুধুমাত্র গৃহের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই সীমারেখার মাঝেও কিছু নারী থেকেছেন অন্য রকম। তারা উচ্চ স্বরে দাবি না তুলেও নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও অদম্য মানসিকতায়। এই প্রবন্ধে আমরা এমনই এক নারীর কথা বলবো, যার শক্তি প্রচারহীন, কণ্ঠস্বর নীরব, কিন্তু উপস্থিতি তীব্রভাবে প্রভাবশালী। একজন দৃঢ় নারীর গল্প- যিনি নিজের পরিচয় খুঁজে পান নিজের ভিতরের আলোয়, এবং যাঁর প্রতিটি নিঃশব্দ সংগ্রাম গড়ে তোলে এক নতুন সাহসী ইতিহাস।
একজন দৃঢ় নারী হওয়া সহজ নয়, এই সত্যটি যুগে যুগে প্রমাণিত। কিন্তু এই পথটি অসম্ভবও নয়, যদি একজন নারী নিজের ভেতরের আলোকে অনুসরণ করতে শেখে। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি কখনো কখনো পরিবার—সবাই মিলে একজন নারীর জীবনকে নির্দিষ্ট কিছু কাঠামোয় বেঁধে রাখতে চায়। বলা হয়, ‘এটাই তোমার কাজ’, ‘এটুকুই যথেষ্ট’, ‘তুমি নারী, তাই এত বেশি চাওয়া ঠিক নয়’। এই নিরব শৃঙ্খল ভাঙার জন্য যে সাহস প্রয়োজন, তা প্রতিটি দৃঢ় নারীর প্রতিদিনের অস্তিত্বেই নিহিত।
নারীর জীবনে কণ্ঠস্বর তোলা যেন এক বিপ্লবের মতো। পৃথিবী অনেক সময়ই নারীর নীরবতাকে তার শ্রেষ্ঠ গুণ হিসেবে প্রশংসা করে। কিন্তু একজন সত্যিকারের শক্তিশালী নারী জানেন, কখন নীরব থাকা প্রয়োজন আর কখন নিজের কথা জোর গলায় বলা উচিত। যখন অন্যেরা চুপ করে থাকেন, তখন তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। যখন তাঁকে দমিয়ে রাখতে চায় সমাজ, তখন তিনি নিজেকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ‘না’ বলতে জানেন—সেই ‘না’ যা তাকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে দেয় না। আবার তিনি জানেন কখন ‘হ্যাঁ’ বলা মানে নিজের স্বপ্নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে থাকে আত্মমর্যাদা, চিন্তা এবং মানবিকতা।
এই শক্তি বাহ্যিক নয়। এটা কোনো ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান দেওয়া কিছু নয়। বরং এটি এক ধরণের মৃদু, গভীর আলো, যা নীরবে জ্বলে, কিন্তু নিভে যায় না। সংসারের ভেতরে, কর্মক্ষেত্রে, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়, প্রতিটি সম্পর্কে তিনি তার এই আলো ছড়িয়ে দেন। এমন অনেক সময় আসে, যখন তিনি ভীষণ ক্লান্ত, ভীষণ একা, কিন্তু তবু তিনি ভেঙে পড়েন না। কারণ তার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অপরাজেয় মানসিক দৃঢ়তা। এই শক্তি তাকে বলে, ‘তুমি পারবে’, এমনকি তখনও যখন সবাই বলে ‘তুমি পারবে না’।
প্রতিদিন সে মায়ের ভূমিকা পালন করে, হয়তো কর্মজীবীও। হয়তো সে একজন ছাত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়, কিংবা নিজেই নিজের স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম করে। সে ভালোবাসে, কিন্তু আত্মবিসর্জন দিয়ে নয়। সে সাহায্য করে, কিন্তু নিজেকে ভুলে নয়। সে জানে, নিজের যত্ন নেওয়া মানে স্বার্থপরতা নয়, বরং টিকে থাকার প্রয়োজন। একজন দৃঢ় নারী শুধু অন্যদের জন্যই জ্বলন্ত মশাল হয়ে থাকেন না, তিনি নিজেকেও আলোকিত করতে শেখেন।
তাকে দেখে হয়তো কেউ ভাববে, “তিনি তো সাধারণ একজন মানুষ”, কিন্তু তার সাহস, সংযম, আর নিঃশব্দ সংগ্রাম তাকে অসাধারণ করে তোলে। সমাজ যাঁদের ‘আলোচিত’ বা ‘নেতা’ বলে চিহ্নিত করে, তাদের চেয়ে বহু গুণে শক্তিশালী সেই নারী, যিনি নীরবে সংসার, সমাজ ও নিজেকে নির্মাণ করেন। তিনি উচ্চ স্বরে দাবি তোলেন না, কিন্তু তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক একটি বিবৃতির মতো। তিনি হাঁটেন মাথা উঁচু করে, কোনো অহংকার নয়, বরং আত্মমর্যাদার ছায়ায়।
প্রতিটি নারীর ভেতরেই এমন এক শক্তি ঘুমিয়ে থাকে, যা তাকে পাহাড় সমান বাধাও অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে। সেই শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা, এবং নিজের প্রতি অটুট আস্থা। একজন দৃঢ় নারী জানেন, কখনো কখনো হার মানার মধ্যেও এক ধরনের শক্তি থাকে, যা তাকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। তিনি জানেন, কাঁদা মানেই দুর্বলতা নয়, বরং তা আবেগের সত্য প্রকাশ।
একজন দৃঢ় নারী মানে নিখুঁত মানুষ নয়। তিনি ভুল করেন, ক্লান্ত হন, ভেঙে পড়েন, কিন্তু তবু আবার উঠে দাঁড়ান। তার এই বারবার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই তাকে অসাধারণ করে তোলে। এই পৃথিবীতে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, এমন অগণিত নারী আছেন যারা নিঃশব্দে জীবনকে জয় করছেন, নিজেকে গড়ে নিচ্ছেন, অন্যদের আলোকিত করছেন। তাদের নীরব চলার পথেই তৈরি হচ্ছে নতুন পৃথিবীর মানচিত্র।
এই নারীদের দেখেই আমরা শিখি, শক্তি মানে শুধু যুদ্ধ নয়, শক্তি মানে সহনশীলতা, দয়া, আত্মসম্মান, আর নিজেকে ভালোবাসার সাহস। এই শক্তিই এক নারীর আসল পরিচয়।
সবশেষে, এই পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে আছেন এমন অসংখ্য দৃঢ় নারী, যারা কোলাহল ছাড়াই ইতিহাস তৈরি করছেন। তাদের শক্তি কোনো তুমুল উচ্চারণে নয়, বরং প্রতিদিনের শান্ত, নিরব সিদ্ধান্তে। তারা হয়তো সংবাদপত্রের শিরোনাম হন না, কিন্তু তাদের জীবনযাপনই হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার এক অক্ষয় উৎস। একজন দৃঢ় নারী জানেন, নিজেকে ভালোবাসা মানেই দুনিয়াকে ভালোবাসার প্রথম ধাপ। তার নিরব সাহস আমাদের শেখায়, আত্মমর্যাদা ছাড়া সত্যিকারের ভালোবাসা সম্ভব নয়। তাই আজ, এই প্রবন্ধের শেষে এসে আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করি, একজন দৃঢ় নারীর নীরব শক্তিই সমাজের প্রকৃত ভিত্তি।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন