বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের বিস্ময়!

gbn

নজরুল ইসলাম ll
লন্ডনে আমার কর্ম পরিসরে কাজ করতে গিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী আনন্দ উপভোগ করি আমার ইংরেজ সহকর্মী Kidd Howard এর সাথে। এক বিকেলে আমরা অফিসে বসে বিভিন্ন বিযয়ে প্রাসঙ্গিক কথা বলছিলাম। আমার মোবাইলে ব্যক্তিগত ফোন আসলে আমি রিসিভ করে বাংলায় খুব দ্রুত কথা বলা শুরু করি। দেখলাম আমার সহকর্মী Kidd Howard চোখ বুজিয়ে বসে আছে। আমি ভাবছিলাম সে বোধহয় বিরক্তবোধ করছে। ফোন শেযে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললাম, আমি দুঃখিত, কথা বলার সময় উচ্চস্বরে ছিলাম। সে বলল, নাজ, আমি অনেক উপভোগ করি প্রতিবার যখন তুমি তোমার ভাষায় কথা বলো- ইহা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সহকর্মী কে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি রসিকতা করছেন? প্রতিউত্তরে সে বলল, নাজ নিঃসন্দেহে এটি খুব মিষ্টি ভাষা। সেদিন আবারো খুব গর্বিত বোধ করেছিলাম।

  অফিসে গুগলে বাংলা ভাষাকে নিয়ে একটু ঘাটি ঘাটি শুরু করলাম। চোখে পড়ল “বাংলা বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা, এমন আনন্দ উত্তেজনাপূর্ণ খবর শুনে আমার পা মাটিতে বসছিল না। চোখে পড়লো ইউনেস্কোর এক সমীক্ষা, যেখানে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসাবে ভোট দেওয়া হয়েছিল, স্পেনীয় এবং ডাচকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মিষ্টি মাতৃভাষা হিসাবে স্থান দেওয়া হয়েছিল। যদিও ইউনেস্কোর সমীক্ষায নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। আমি এটিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি, কারণ, আমি আমার মাতৃভাষা সম্পর্কে বিভ্রান্ত নই। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃত এবং ২০১০ সালে জাতিসঙ্গের সাধারণ পরিষদ এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আর এভাবেই বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলমান। পাঠক, এখন সারা বিশ্বের ১৯১টি দেশে একযোগে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষা এখন আর বাংলা ভাষাভাষীর নয়, সারা বিশ্বের। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে কোনো দেশে আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে। রক্ত ও জীবন দিয়ে বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা ভাষা এখন বিশ্ব বাঙালির সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার,শহীদ মিনার। 

মাতৃভাষার সুরক্ষা বিকাশ এবং অনুশীলন ছাড়া কোনো জাতি অগ্রসর হতে পারে না। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম নজির এটি। তাদের রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খলযুক্ত হয়েছিল বর্ণমালা ও মায়ের ভাষা। যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল যা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতির কাছে চির প্রেরণার প্রতীক।

একুশের প্রথম প্রহর থেকেই জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সবার কণ্ঠে বাজে একুশের অমর শোকসঙ্গীত-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। এই দিনটি ঐতিহ্যের পরিচয়কে দৃঢ় করেছে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করেছে। ১৯১৩ সালে এ ভাষার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার অমর কাব্যগন্থ ‘গীতাঞ্জলী’ রচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ ভাষার অসাধারণ প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব পরিমণ্ডলে। 

পাঠক, একটু পিছু ফিরলে ও সঠিক ইতিহাসের রেফারেন্স টানলে একুশ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা দেয়, উজ্জীবিত করে। অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের হাত ধরে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা-না উর্দু ? এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন আবুল মনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে ভাব বিনিময় অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় পূর্ব বাংলায় শুরু হয় বিক্ষোভ প্রতিবাদ। ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালিত হয়। ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতারা ও জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘Students Role in nation building’ শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদানকালে ক্যাটাগেরিক্যালি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে। জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তনস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাড়িয়ে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করে। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্বে পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।পাঠক, ভাযা আন্দোলনের ইতিহাস মমৃদ্ধ ,বিস্তৃত আলোচনা করলে শেয হবে না। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭১ পরবর্তী বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘে কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচটি ভাষায়। সব দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তথা জাতিসংঘের নিযুক্ত প্রতিনিধিরা উক্ত পাঁচটি ভাষার যে কোনো একটি ভাষায় ভাষণ দেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার মহত্ব। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বজুড়ে অমর একুশের উদযাপন নিঃসন্দেহে এক বিশাল জাতীয় গৌরব ও সম্মানের। ২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা। ভাষা সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এটি ভাষার ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে যা বাংলা ভাষাকে বিশ্বমর্যাদায় আসীন করতে ভূমিকা রাখছে। 

পাঠক, শেয করতে চাই ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য দিয়ে , এই বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি থিমের অধীনে পালিত হবে: বহুভাষিক শিক্ষা - বহুভাষিক বিশ্বে শিক্ষার রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা। শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুভাষাবাদকে উত্সাহিত করা ” স্বীকৃতি দেওয়া যে, ভাষা এবং বহুভাষিকতা অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিতে পারে, এবং কাউকে পিছনে না রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। ইউনেস্কো বিশ্বাস করে যে, প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার প্রাথমিক বয়স থেকেই শৈশবকালীন যত্ন এবং শিক্ষাই শিক্ষার ভিত্তি হিসাবে শুরু করা উচিত।

লেখক: ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন