ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকারী উদ্যোগ ও প্রসঙ্গকথা

দে লো য়া র  জা হি দ ||

বাংলাদেশে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত সোমবার ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ এর সভাপতিত্বে ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত ধারণাপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় (৩১ জানুয়ারি, বাসস) : করণাকালীন এ সময়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করে চলেছে গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে উচ্চশিক্ষা, যখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে, সাংস্কৃতিক ভাবে এবং অন্যান্য উপায়ে - অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিত্যদিন সংগ্রাম করে চলেছে যখন অ্যাকাডেমিয়া সংগ্রাম করছে তার কিছু কিছু বিষয় নিয়মিতই  গণমাধমে উঠে আসছে। তখন সরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছে।

 ইউজিসি  সভার বরাত দিয়ে বাসস জানায় যে দেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ: ২০১৮-২০৩০’ এর পাঁচ বছর মেয়াদী অগ্রাধিকার কার্যক্রম বা¯তবায়নের অংশ হিসেবে দেশে একটি বিশ্বমানের ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ও ডক্টরাল ডিগ্রি প্রদান করা এবং গবেষণার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হবে। "ফ্ল্যাগশিপ" বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা মূলত বুঝি - শীর্ষস্থানীয় স্নাতক ছাত্রদের শেখানোর প্রতিশ্রুতি সহ বিশ্বমানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চ-স্তরের পেশাদার শিক্ষা প্রদান এবং নাগরিক সম্পৃক্ততা, প্রচার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে উঠা কোন  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ইউজিসি বাংলাদেশে ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক  তৈরি করবে,  এ কথা  জানিয়ে, দেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার উৎকর্ষ সাধন তথা গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্বারা বিশ্বজ্ঞান ভান্ডরকে সমৃধ্ব করবে।  দেশের উচ্চশিক্ষায় ফলপ্রসূ গবেষণার কোন বিকল্প নেই। প্রফেসর বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, "ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধারণাপত্র তৈরির জন্য ইউজিসি একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি চলতি মাসের মধ্যে ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা সম্বলিত লিখিত মতামত কমিশনে জমা দিবে। ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় যাতে দেশের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে সেদিকে ইউজিসি নজর রাখবে।"

ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত এ সভায় ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র পরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, ইউজিসি প্রফেসর ড. হাসিনা খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ এ মামুন এবং ইউজিসি’র স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং এন্ড কোয়ালিটি এসুরেন্স বিভাগের পরিচালক ড. মো. ফখরুল ইসলাম যুক্ত ছিলেন।

ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে রাজ্যের বা কোনো প্রদেশের সেরা পরিচিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়  যা সাধারণত প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও যা সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে নির্বাচনী, সেসাথে সবচেয়ে গবেষণা-নিবিড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিপরীতে, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা স্নাতক এবং স্নাতোকত্তোর উভয় ডিগ্রী প্রদান করে যা একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিবেচিত। তারা স্নাতক প্রোগ্রাম অফার করে যা একজন শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স ডিগ্রি বা ডক্টরেটের দিকে নিয়ে যাবে। যারা সে ক্ষেত্রগুলিতে পেশাদার ডিগ্রি অর্জন করছেন তাদের জন্য তাদের একটি মেডিকেল বা আইন স্কুল ও থাকতে পারে।

ডগলাসের মডেলে, একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠানের নিম্নলিখিত উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্চনীয়:
• স্বতন্ত্র মানুষের ক্ষমতার উন্নতি;
• সমাজের মূল্যায়ন;
• একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে অবদান;
• উৎপাদনশীল শিক্ষা এবং গবেষণা পরিবেশের সৃষ্টি; এবং
• নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও অতীতের জ্ঞান সংরক্ষণ।

আফ্রিকান উন্নয়নের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাই যে তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আফ্রিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং জ্ঞান উৎপাদন ও আফ্রিকার শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জৈবিক পরিবেশ ও  বিদ্যমান ডেটার মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে। আফ্রিকা দরিদ্রতম মহাদেশ হওয়ার রেকর্ড রয়েছে, এখনও ক্ষুধা, রোগ, দারিদ্র, অজ্ঞতা, দুর্নীতি, যুদ্ধ এবং খারাপ শাসন দ্বারা বিধ্বস্ত সে দেশ .

ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধারণা এখানে প্রাসঙ্গিকতা এবং স্থানীয়দের উদ্বেগের সাথে ভালো ভাবে তা অনুরণিত হয় যে তারা স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয়ভাবে ব্যাপক এবং গবেষণা-নিবিড় প্রতিষ্ঠান হতে পারে। তাদের ভর্তির মানদন্ড অত্যন্ত নির্বাচনী; তারা ব্যাপকভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য ও একটি দেশের আর্থ-সামাজিক এবং জাতিগত জনসংখ্যার প্রতিনিধি, একই সাথে আন্তর্জাতিক প্রতিভাকে ও বন্দোবস্ত করে।

ফ্ল্যাগশিপ স্ট্যাটাস নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত মানদণ্ডগুলি দেশ থেকে দেশে পরিবর্তিত হয় , সাধারণত একটি দেশের ফ্ল্যাগশিপ হল তার জমি-অনুদান প্রতিষ্ঠান। এটি সম্ভবত সর্বোচ্চ গবেষণা প্রোফাইল এবং সর্বাধিক ডক্টরাল প্রোগ্রাম সহ বিশ্ববিদ্যালয় ও  হতে পারে। এটি দেশের/রাজ্যের মেডিকেল স্কুল, আইন স্কুল বা উভয়ই থাকতে পারে। এটি দেশের বা রাজ্যের বৃহত্তম এবং সেরা অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলির মর্যাদাপূর্ণ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ অন্য কোনো কারণ ও হতে পারে।  সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে, ফ্ল্যাগশিপ শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে তা নয় । টেক্সাসে, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস এএন্ডএম উভয়কেই ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং আরও বিশ্ববিদ্যালয়কে "ফ্ল্যাগশিপ" মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য এটি একটি চাপ হিসেবে মনে করা হয় ৷ যাইহোক, সাধারণত "ফ্ল্যাগশিপ" শব্দটি মনোনীত করার জন্য এক ধরণের প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয় এবং বেশিরভাগ তালিকায় প্রতি রাজ্যে শুধুমাত্র একটি ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত থাকে ।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ব-মানের মর্যাদা খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করার পূর্বে স্থানীয় সম্পদ, মানুষ, সমস্যা এবং সুযোগগুলি বিবেচনা নিয়ে দেশীয় গবেষণা এবং জ্ঞান অর্জনের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। ঔপনিবেশিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের সমর্থনকারী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির দ্বারা নির্ধারিত গবেষণা প্রকল্পের এজেন্ডাগুলির উপর নির্ভর করার পরিবর্তে, কঠোর অভ্যন্তরীণ গবেষণা, জ্ঞান এবং বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার বিকাশের অগ্রযাত্রায় পরিবর্তনের  এজেন্ট হিসাবে বাংলাদেশীদের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট কমান্ড নির্বাহী, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন